চুক্তিতেই আটকে আছে পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি
গত বছরের ৩ মে রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমাকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। পরদিন তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যাওয়ার সময় হত্যার শিকার হন মাইক্রোবাসের বাঙালি চালক ও চারজন পাহাড়ি। খাগড়াছড়ি শহরের খবংপুড়িয়ায় গত বছরের ১৮ আগস্ট দিনদুপুরে দুর্বৃত্তরা ছয়জন পাহাড়িকে হত্যা করে। চলতি বছরের ৮ মে বান্দরবান সদর উপজেলায় দুর্বৃত্তরা হত্যা করে পাহাড়ি একজন ছাত্রনেতাকে। পাহাড়ে হত্যা চলছেই।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ পাহাড়ি সংগঠনগুলো পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তুলেছে। পাহাড়ি রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতারা এমন ধারার হত্যাকাণ্ডকে বলেছেন ‘ভ্রাতৃঘাতী’।
বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে গত বছর পার্বত্য চট্টগ্রাম বাদে দেশের অন্যত্র রাজনৈতিক সহিংসতায় ৬৭ জন নিহত হয়। আর প্রথম আলোর হিসাব বলছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানীয় আঞ্চলিক দলগুলোর সংঘাতে নিহত হয় অন্তত ৪৭ জন। দেশের এক-দশমাংশ এলাকা নিয়ে তিনটি পার্বত্য জেলা। জনসংখ্যা ১৬ লাখের কিছু বেশি।
পাহাড়ি জাতিসত্তার মানুষদের স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সশস্ত্র সংগঠন শান্তিবাহিনী দীর্ঘ ২২ বছর রাষ্ট্রের সঙ্গে লড়াই চালিয়েছে। রাষ্ট্র একপর্যায়ে সেখানে বাঙালি অভিবাসনের কৌশলও নেয়। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকেই অঞ্চলটি পাহাড়িদের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনী ও বাঙালিদের সংঘাত-সংঘর্ষে অশান্ত ছিল।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তির লক্ষ্যে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে জেএসএসের চুক্তি হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান গত এপ্রিলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘চুক্তির পর আমাদের বিরাট আশা তৈরি হয়েছিল। চুক্তির মধ্য দিয়ে অনেক কিছু অর্জিতও হয়েছে। তারপরও এখন পাহাড়ে যেন চুক্তির আগের সেই পরিবেশ তৈরি হয়েছে।’
সংঘাত, চ্যালেঞ্জ ও চুক্তি
আগে সংঘাত হতো মূলত রাষ্ট্র ও স্বায়ত্তশাসনকামী পাহাড়িদের মধ্যে। চুক্তি এবং চুক্তির বাস্তবায়নের ধীর গতিকে কেন্দ্র করে জেএসএস ও পাহাড়ি ছাত্র সংগঠনগুলো কয়েক ভাগে ভেঙে গেছে। এখন সংঘাত হচ্ছে মূলত এসব দলের মধ্যে।
এ ছাড়া ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কাপেং ফাউন্ডেশনের হিসাবে ২০১৬-১৭ সালে নিরাপত্তা বাহিনী ও বাঙালিদের হাতে ১৮ জন পাহাড়ি নিহত এবং কয়েক শ আটক, নির্যাতন বা হুমকি-হামলার শিকার হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং প্রথম আলোকে বলেন, ‘নাগরিক হিসেবে আমার কিছু উদ্বেগ আছে। তবে পরিস্থিতি উন্নয়নে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সচেষ্ট আছে।’ তিনি আরও মনে করেন, চুক্তি বাস্তবায়নে অগ্রগতি আছে।
তবে বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক ও নাগরিক নেতা এবং গবেষক ও বিশেষজ্ঞ বলছেন, চুক্তির ২১ বছর পরও পাহাড়ে শান্তি ও আস্থা ফেরেনি। সেখানে পাহাড়ি-বাঙালি স্বার্থের সংঘাত মীমাংসিত হয়নি। কাঙ্ক্ষিত আর্থসামাজিক উন্নয়ন হয়নি। পরিবেশের বিনাশ চলছেই। আর এসবই চুক্তির কার্যকর বাস্তবায়ন না হওয়ার জের।
সুতরাং সরকারের জন্য তাৎক্ষণিক এবং দীর্ঘমেয়াদি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে চুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর কার্যকর বাস্তবায়ন করা। স্থানীয় বাঙালি সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরাও চুক্তির কিছু বিষয়ে সংশোধনসহ এর বাস্তবায়ন দেখতে চান। চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য একটি জাতীয় কমিটি আছে। ২০০৯ সাল থেকে গত মার্চ পর্যন্ত কমিটি মাত্র সাতটি বৈঠক করেছে।
চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো হচ্ছে: ভূমি সমস্যার কার্যকর সমাধান, ভোটার তালিকার সুরাহা, জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন, পরিষদগুলোকে যথাযথ ক্ষমতা দেওয়া, স্থানীয় পুলিশ বাহিনী গঠন, বেসামরিকীকরণ, অভিবাসন করানো বাঙালিদের বিষয় সুরাহা, আর্থসামাজিক উন্নয়ন এবং পাহাড়ের প্রকৃতির সুরক্ষা।
জেএসএসের সভাপতি ও আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় ওরফে সন্তু লারমা গত বছরের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে আটটি দাবি জানান। এর মধ্যে আছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প ও সেনাবাহিনীর চলতি অপারেশন ‘উত্তরণ’ প্রত্যাহার এবং তিন জেলায় স্থানীয় পুলিশ বাহিনী তৈরি। গত মার্চে তিনি আঞ্চলিক ও জেলা পরিষদকে কার্যকর করার দাবিও তুলেছিলেন।
চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, সরকার ইতিমধ্যে অনেক সেনাক্যাম্প তুলে নিয়েছে, ভূমি কমিশন আইনও করেছে। তিনি বলেন, ‘এক দিনে এসবের সমাধান হবে না। তবে আমরা আন্তরিক।’
অনির্বাচিত, ক্ষমতাহীন পরিষদ
শান্তি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ১৯৮৯ সালে সরকার তিন জেলায় তিনটি স্থানীয় সরকার পরিষদ করেছিল। চুক্তির পর এগুলো পার্বত্য জেলা পরিষদ হিসেবে পুনর্গঠিত হয়। এ ছাড়া হয় আঞ্চলিক পরিষদ।
চুক্তি অনুযায়ী, স্থানীয় পাহাড়ি এবং অ-উপজাতীয় স্থায়ী বাসিন্দারা প্রত্যক্ষ ভোটে জেলা পরিষদ নির্বাচিত করবেন। নির্বাচিত এই প্রতিনিধিরা আঞ্চলিক পরিষদকে নির্বাচিত করবেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত জেলা পরিষদগুলোতেই কোনো নির্বাচন হয়নি। ভোটার তালিকাও হয়নি।
প্রতিটি সরকার নিজেদের পছন্দমতো নেতাদের দিয়ে জেলা পরিষদ গড়ে। রাঙামাটি জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান চিং কিউ রোয়াজা যেমন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক ফ্যাক্স বার্তায় আমি চেয়ারম্যান হয়েছিলাম। আরেক ফ্যাক্স বার্তায় আমার পদ চলে গিয়েছিল।’
জেলা পরিষদ কিন্তু আইনত অনেক শক্তিশালী। চুক্তি অনুযায়ী ভূমি, স্থানীয় পুলিশ, স্থানীয় পর্যটন, বিভিন্ন করসহ মোট ৩৩টি বিষয় জেলা পরিষদের তদারকিতে থাকবে। তবে প্রশাসনের কাছ থেকে দায়িত্ব হস্তান্তরের গতি অতি ধীর। কোনো জেলা পরিষদ এখনো ভূমি, বন এমনকি একটি স্থানীয় পুলিশ বাহিনীর মতো দায়িত্বগুলো পায়নি।
তবে এই অনির্বাচিত পরিষদের হাতে দায়িত্ব দেওয়া নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন আছে। কিন্তু নির্বাচন হতে বাধাটা কোথায়?
ভূমি আর অন্তর্দ্বন্দ্ব
আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য গৌতম কুমার চাকমা জেএসএসের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পার্বত্য সমস্যার মূল হচ্ছে ভূমি সমস্যা। আজ পর্যন্ত সেই সমস্যার সুরাহা হয়নি।’ তাঁর মতে, চুক্তি মোতাবেক ভোটার তালিকা প্রণয়ন করতে হলে আগে মানুষকে তার ভূমি ফিরে পেতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র লড়াইয়ের সময় প্রায় ১৩ হাজার পাহাড়ি পরিবার ভারতে চলে গিয়েছিল। প্রায় ৯৩ হাজার পরিবার অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হয়েছিল। আবার গত শতকের ১৯৭৯-৮০-এর দশকের গোড়ায় সরকার প্রায় চার লাখ ভূমিহীন বাঙালিকে পাহাড়ে পুনর্বাসিত করে। পাহাড়ি মানুষজনের অভিযোগ, তাদের জমিতেই এই বাঙালিদের বসানো হয়।
কথা ছিল, চুক্তির আওতায় গঠিত ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন প্রকৃত মালিককে জমির মালিকানা বুঝিয়ে দেবে। কিন্তু এই কমিশন গঠনের প্রক্রিয়ায় এবং বিতর্কে প্রায় দুই দশক চলে গেছে। অবশেষে গত বছর আইনটি সংশোধনের পর কমিশন নতুন করে গঠিত হয়েছে। বিধিমালা এখনো হয়নি। এযাবৎ কমিশনের কাছে ২২ হাজারের বেশি আবেদন জমা পড়েছে।
১৯৭৯-৮০ সালে পুনর্বাসিত বাঙালিদের সঙ্গে ভূমিবিরোধের সুরাহা হওয়াটা সাবেক উদ্বাস্তু পাহাড়িদের জীবন-জীবিকার প্রশ্ন। পক্ষান্তরে চুক্তি অনুযায়ী অ-উপজাতীয় অর্থাৎ বাঙালিদের ভোটার হতে গেলে পাহাড়ের স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে। ভূমির মালিকানা নিরঙ্কুশভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। নয়তো তাঁরা স্থায়ী বাসিন্দার স্বীকৃতি পাবেন না।
তালিকা করার এই বিধি নিয়েই কিন্তু বাঙালিদের আপত্তি আছে। তাদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন পার্বত্য নাগরিক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ইয়াকুব আলী চৌধুরীর যুক্তি, পুনর্বাসিত বাঙালিরা পাহাড়ে একাধিক প্রজন্ম পার করেছে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘এখানে তাঁরা ভোটার হবেন না কেন?’
এখন সংসদ এবং ইউনিয়ন ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ভোটার তালিকায় পুনর্বাসিত বাঙালিরা অন্তর্ভুক্ত। ইয়াকুব চৌধুরীর প্রশ্ন, তা হলে জেলা পরিষদের জন্য স্থায়ী বাসিন্দার শর্তযুক্ত আলাদা ভোটার তালিকা কেন লাগবে?
সশস্ত্র সংগ্রামের সময় পাহাড়িদের একটা বড় দাবি ছিল পুনর্বাসিত বাঙালিদের প্রত্যাহার। কিন্তু চুক্তিতে এই জনগোষ্ঠী সম্পর্কে কোনো কথা নেই। একে চুক্তির একটি ‘দুর্বলতা’ বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আমেনা মোহসীন।
আবার এ চুক্তি পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি মেটায়নি—এমন কথা বলে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কিছু নেতা তখনই নতুন দল গঠন করেছিলেন। ইউপিডিএফ নামে পরিচিত এই সংগঠনের সঙ্গে জেএসএসের দ্বন্দ্বে পাহাড়ে অশান্তি জিইয়ে থাকে।
২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় জেএসএস ভেঙে তৈরি হয় জেএসএস-এম এন লারমা দল। ২০১৭ সালের নভেম্বরে ইউপিডিএফ ভেঙে তৈরি হয় ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক দল। পাহাড়ের রাজনৈতিক নেতৃত্বের একাংশের অভিযোগ, এসব ভাঙন ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের পেছনে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা আছে। পক্ষান্তরে প্রশাসন দায়ী করে স্থানীয় উপদলীয় কোন্দলকে।
উন্নয়ন ও পরিবেশের কথা
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য (২০১৬) বলছে, পাহাড়ে দরিদ্র ও চরম দরিদ্র মানুষের হার জাতীয় হারের দ্বিগুণ। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার (২০১৬-২০) দলিলে আছে, ‘সব ধরনের উন্নয়ন নির্দেশকের নিরিখে পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা এবং ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের একটি।’
২০১৭ সালে রাঙামাটি ও বান্দরবানে পাহাড়ধসে প্রাণ হারায় ১২৬ জন। সে বছর সরকারের সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) এবং বেসরকারি সংস্থা ওয়াটারএইড বাংলাদেশ পাহাড়ের পরিবেশ নিয়ে একটি গবেষণা করে। গবেষণাটি বলছে, ২০০৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে পার্বত্য তিন জেলার প্রায় ৩০ শতাংশ প্রাকৃতিক বন ধ্বংস হয়েছে। শুকিয়ে গেছে ৬১ শতাংশ ঝরনা। ফলে পাহাড়ের মাটির গাঁথুনি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।
আশির দশক থেকে সরকার মূলত বাঙালি উদ্যোক্তাদের পাহাড়ি জমি লিজ দিয়ে আসছিল, বিশেষত বান্দরবানে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলন নামের স্থানীয় একটি সংগঠনের হিসাবে বান্দরবানে এমন জমির পরিমাণ ৪৭ হাজার একর। মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র অবশ্য বলেছে, লিজ দেওয়া এখন বন্ধ আছে।
এমন লিজ চুক্তি-গর্হিত। পরিবেশের সুরক্ষা এবং সার্বিকভাবে পাহাড়ের মানুষের উন্নয়নের জন্যও ঘুরেফিরে চুক্তির বাস্তবায়ন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকছে।