চিঠির জবাবে গুলি, পরে আত্মসমর্পণ
একাত্তরের নভেম্বর থেকে পিছু হটতে থাকে পাকিস্তানি সেনারা। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি আত্মসমর্পণের ঘটনা ঘটে। আজ পড়ুন কামালপুরের কাহিনি
মুক্তিযোদ্ধা বশির আহমেদ তখন ১৫ কি ১৬ বছরের কিশোর। তার ওপরই বর্তায় এক দুঃসাহসিক কাজের ভার। আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো চিঠি নিয়ে যেতে হবে শত্রুশিবিরে। চতুর্মুখী আক্রমণে অবরুদ্ধ পাকিস্তানি বাহিনী তখন তেতে আছে। তবু ৪ ডিসেম্বর সকালে এক হাতে মেজর জেনারেল গিলের চিঠি আর আরেক হাতে সাদা পতাকা নিয়ে কিশোর বশির আহমেদ রওনা দেন।
৪৪ বছর আগের সেই দিনটির কথা স্মরণ করতে গিয়ে বশির আহমেদ বলেন, ‘হয়তো আর প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারব না—এই আশঙ্কায় সহযোদ্ধাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলাম। সহযোদ্ধারা ছিলেন বাক্রুদ্ধ। সকাল আটটায় রওনা হই। চিঠি আর সাদা পতাকা নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বাংকারে প্রবেশ করি। চিঠি তুলে দিই ক্যাপ্টেন আহসান মালিকের হাতে।’
শুরুতে গুলি চালিয়ে চিঠির জবাব দিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী। কিন্তু দর্প বেশিক্ষণ টেকেনি। ভেতরে ভেতরে মনোবল ভেঙে গিয়েছিল তাদের। ওই দিন রাতে মাথা হেঁট করে সাদা পতাকা হাতে চৌকি থেকে বের হয়ে আত্মসমর্পণ করেন পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাপ্টেন আহসান মালিক ও তাঁর বাহিনী।
৪ ডিসেম্বর জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলার ধানুয়া ইউনিয়নের কামালপুর মুক্ত হলেও সেখানে যুদ্ধটা চলেছে অনেক দিন ধরে। জুন মাসেই মুক্তিবাহিনী সিদ্ধান্ত নেয়, কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ কামালপুর বিওপি যেকোনো মূল্যে দখলে নিতে হবে। ছোট-বড় অনেক লড়াই চালিয়েছে মুক্তিবাহিনী। এসব লড়াইয়ে প্রাণ দিয়েছেন ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দীনসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা। পা হারিয়েছেন সেক্টর কমান্ডার আবু তাহের বীর উত্তম। আহত হয়েছিলেন তৎকালীন ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমদ ও লেফটেন্যান্ট মো. আবদুল মান্নান।
তবে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে এখানে যুদ্ধের চেহারা বদলে যায়। তখন ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি ব্রিগেড যুক্ত হয় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে। ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল এলাকায় ১১ নম্বর সেক্টর ও ভারতের পক্ষে ১০১ কমিউনিকেশন জোন অভিযানে অংশ নেয়। নেতৃত্ব থাকে ওই জোনের কমান্ডার মেজর জেনারেল গুরবক্স সিং গিলের হাতে।
৪ ডিসেম্বর চলে সাঁড়াশি আক্রমণ। সকালে পাকিস্তানি বাহিনীর বকশীগঞ্জ কোম্পানির কমান্ডার মেজর আইয়ুব কামালপুর বিওপিতে রসদ পৌঁছে দিতে গেলে যৌথ বাহিনীর আক্রমণে তিনিসহ নয়জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হন।
সকালে ভারতীয় বিমান বিওপিতে আক্রমণ চালায়। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে প্রথম বিমান হামলার পর আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে বিওপির দায়িত্বপ্রাপ্তµক্যাপ্টেন আহসানের উদ্দেশে প্রথম চিঠি পাঠান জেনারেল গিল। সেই চিঠি নিয়ে গিয়েছিলেন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা বশির আহমেদ। তিনি বলেন, কোণঠাসা পাকিস্তানি বাহিনী রাগে ফুঁসতে থাকলেও পত্রবাহক হিসেবে তাঁর সঙ্গে অশোভন আচরণ করেনি। এমনকি তাঁকে রুটিও খেতে দিয়েছিল তারা।
মেজর জেনারেল গিল তাঁর চিঠিতে ক্যাপ্টেন আহসানকে লেখেন, ‘...আপনার চৌকির সময় শেষ হয়ে গেছে এবং আপনি যা কিছুই করুন না কেন, আমরা কামালপুর চৌকি ধ্বংস করবই। আমার এই চিঠি প্রেরণের উদ্দেশ্য আপনাদের এবং আমাদের উভয় পক্ষের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো।’
কিন্তু আত্মসমর্পণে রাজি হননি ক্যাপ্টেন আহসান। গুলি চালিয়ে চিঠির জবাব দিয়েছিলেন। দুপুরে দ্বিতীয় বিমান হামলার পর ক্যাপ্টেন আহসানকে আবারও চিঠি দেন জেনারেল গিল।
তৃতীয় বিমান হামলার পর আবারও চিঠি। আবারও গুলি ছুড়ে জবাব।
তবে ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়েছিল অবরুদ্ধ পাকিস্তানি বাহিনী। লড়াই চালিয়ে যাওয়ার শক্তি অবশিষ্ট ছিল না তাদের। রাত সাড়ে সাতটায় ক্যাপ্টেন আহসান চৌকি থেকে বেরিয়ে জেনারেল গিলের কাছে যখন আত্মসমর্পণ করেন, তাঁর সঙ্গে ছিলেন ৩১ বালুচের একজন জেসিও, অন্যান্য পদবির ৬০ সেনা সদস্য, ৪০ জন রেঞ্জার্স ও ৪১ জন রাজাকার।
সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাৎপর্যপূর্ণ কামালপুরের যুদ্ধ পড়ানো হয় বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের বিভিন্ন সামরিক প্রশিক্ষণকেন্দ্রের পাঠ্যসূচিতে।
বকশীগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের কার্যালয় সূত্র জানায়, ১২ জুন থেকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত কামালপুর রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর ১০টি সম্মুখযুদ্ধ হয়। এসব যুদ্ধে মোট ১৯৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত বরণ করেন। এ সময় নিহত হন ৪৯৭ জন পাকিস্তানি সেনা।