চাহিদা নেই, তবু নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র
দেশে এখন প্রায় ১৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা রয়েছে। তবে চাহিদা না থাকায় চলতি গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে গড়ে সাড়ে ৮ হাজার থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ১২ হাজার মেগাওয়াট। এতে মোট ক্ষমতার প্রায় অর্ধেক বিদ্যুৎকেন্দ্রই অলস পড়ে আছে। এরপরও সরকারঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। বিনা দরপত্রে দেওয়া এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনে’ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনাও (পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান) মানা হচ্ছে না। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৩১ সালে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা গিয়ে দাঁড়াবে ৩৭ হাজার মেগাওয়াট। এ সময় বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা থাকবে ২৯ হাজার মেগাওয়াট। মোট ক্ষমতার ২০ থেকে ২৫ শতাংশের বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসিয়ে রাখা যাবে না। বর্তমানে সেখানে অলস বসে আছে প্রায় ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র। আবার সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনের সক্ষমতা না থাকায় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মোট স্থাপিত ক্ষমতার একটি অংশ উৎপাদন করা যায় না। এতে সারা দেশে বিভিন্ন স্থানে অনেক সময় বিদ্যুৎ থাকে না। এ পরিস্থিতিতে গত মার্চে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদন না দিতে বিদ্যুৎ বিভাগের গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেল সুপারিশ করেছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ সরকার আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি)ভিত্তিক দুটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমতি দিয়েছে। একটি পেয়েছে পদ্মা ব্যাংকের (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক) চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ শরাফাতের মালিকানাধীন ইউনিক মেঘনাঘাট পাওয়ার লিমিটেড। এটির উৎপাদন ক্ষমতা ৫৮৪ মেগাওয়াট। গত ২৪ জুলাই বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সঙ্গে ইউনিক মেঘনাঘাট পাওয়ার লিমিটেডের বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি (পিপিএ) হয়। অন্যটির অনুমোদন পেয়েছে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী মাহমুদুল হকের প্রতিষ্ঠান আনলিমা টেক্সটাইল লিমিটেড। পিডিবির সঙ্গে ৪৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের এখনো পিপিএ হয়নি।
এ মুহূর্তে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রের দরকার আছে কি না, জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান খালিদ মাহমুদ মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনায় মধ্য মেয়াদে ২০২৫-২০২৬ সালের মধ্যে যেসব কেন্দ্র আসবে, তারই অনুমতি দেওয়া হচ্ছে এখন। এগুলো সবই এলএনজিভিত্তিক।
যদিও বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, মধ্যমেয়াদি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নির্মাণে ২০১১ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। আর স্বল্প মেয়াদে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পর্ব শেষ হয় ২০১৩-১৪ সালের মধ্যে। এরপরও এক বছরের মধ্যে উৎপাদনে আনার শর্ত দিয়ে ২০১৭ সালের শেষের দিকে তেলভিত্তিক ১০টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেয় সরকার। এগুলোর স্থাপিত ক্ষমতা ১ হাজার ৭৬৮ মেগাওয়াট। এসব কেন্দ্রে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় প্রতি ইউনিট ১৪ থেকে ২৫ টাকা। এগুলোর মধ্যে একটি ১০০ মেগাওয়াটের কেন্দ্র বাদে বাকিগুলো বেসরকারি মালিকানাধীন। এই কেন্দ্রগুলোও বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনায় ছিল না। আর পাওয়ার সেল বলছে, ২০৩০ সালের হিসাব অনুযায়ী চুক্তি হওয়া এবং নির্মাণাধীন বিদ্যুৎ প্রকল্পের বাইরে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র দরকার নেই। কারণ, দেশে বিদ্যুতের তত চাহিদা নেই।
এ বিষয়ে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেইন প্রথম আলোকে মুঠোফোনে বলেন, ‘বিনিয়োগকারীরা বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমতি পেতে অস্থির হয়ে পড়েছে। অথচ বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনার বাইরে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রয়োজন নেই। নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদন না দিতে সরকারের কাছে আমরা সুপারিশ করেছি।’
চাহিদার চেয়ে উৎপাদন ক্ষমতা বেশি
পিডিবির তথ্য অনুযায়ী, দিনের শুরুতে বর্তমানে বিদ্যুতের চাহিদা সর্বোচ্চ সাড়ে ৮ হাজার থেকে ৯ হাজার মেগাওয়াট। আর দিনের শেষ ভাগে (সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত, যা পিক আওয়ার নামে পরিচিত) বিদ্যুতের চাহিদা গিয়ে দাঁড়ায় সর্বোচ্চ ১১ হাজার থেকে সাড়ে ১২ হাজার মেগাওয়াট। অথচ দেশে ১৮ হাজার ৯৬১ মেগাওয়াট ক্ষমতার স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। তাই দিনরাত মিলিয়ে ১৪-১৬ ঘণ্টা গড়ে ৮ হাজার থেকে ৯ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসে থাকছে। শীতকালে এ চাহিদা নেমে ৬ হাজার মেগাওয়াটে চলে আসে।
পাওয়ার সেলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে ছয়টি সরকারি কোম্পানি, পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, বেসরকারি কেন্দ্র ও বিদেশ থেকে আসবে ২৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এর সঙ্গে পিডিবির নিজস্ব উৎপাদন ৯ হাজার মেগাওয়াট যোগ করলে তখন উৎপাদন ক্ষমতা হবে ৩৭ হাজার মেগাওয়াট। অথচ ২০৩০ সালে দেশের বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা গিয়ে দাঁড়াবে ২৯ হাজার ৬১৯ মেগাওয়াট। এ সময় পিক আওয়ারে চাহিদা মেটাতে কোনো সমস্যা হবে না।
জ্বালানি (তেল কিংবা গ্যাস), কেন্দ্রভাড়া (ক্যাপাসিটি পেমেন্ট) ও বিদ্যুতের মূল্য বাবদ বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে অর্থ দেয় সরকার। এর ফলে অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকেও কেন্দ্রের ভাড়া দিতে হয়। ১০০ মেগাওয়াট একটি কেন্দ্রের ক্ষেত্রে বছরে গড়ে শুধু কেন্দ্রভাড়াই দিতে হয় ৯০ কোটি টাকার বেশি। ফলে কোনো বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন না করে বসিয়ে রাখলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের কেন্দ্রভাড়া দিতে গিয়ে সরকারের লোকসান বাড়ে। সরকারি কেন্দ্রের ক্ষেত্রে কেন্দ্রভাড়া দেওয়া লাগে না।
শিল্পকারখানায় পিডিবির বিদ্যুৎ কম ব্যবহৃত হয়
সরকারের সর্বশেষ পরিকল্পনায় বিদ্যুতের নতুন গ্রাহকের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৪ শতাংশ। তবে আবাসিক গ্রাহকের প্রবৃদ্ধি ঠিকমতো হলেও শিল্পগ্রাহকের কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি হয়নি বলে পিডিবির সূত্রে জানা গেছে। পিডিবির তথ্য বলছে, বিদ্যুতের বেশি ব্যবহার শিল্পকারখানায় হলেও বর্তমানে শিল্পমালিকেরা প্রায় সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নিজেরা উৎপাদন করে (ক্যাপটিভ পাওয়ার) তাঁদের কারখানায় ব্যবহার করেন। সম্প্রতি সরকার নতুন করে আরও ৮০০ শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে ক্যাপটিভ বিদ্যুতের অনুমোদন দিয়েছে। ফলে শিগগিরই শিল্পে নতুন বিদ্যুতের চাহিদা খুব একটা বাড়বে না।
বিষয়টি স্বীকার করে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেইন বলেন, ‘সরকারি বিদ্যুতের দাম বেশি এবং তা নিরবচ্ছিন্ন নয়। বিষয়টি কীভাবে শিল্পকারখানার উপযোগী করা যায়, তা নিয়ে আমরা ভাবছি। কারণ, সরকারের হাতে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ রয়েছে। অথচ শিল্পকারখানায় বিদ্যুতের ব্যবহারে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না। এখন দরকার বিদ্যুৎ সঞ্চালনে বড় বিনিয়োগ।’ ব্যবসায়ীদের সঞ্চালনব্যবস্থায় বিনিয়োগে আসা উচিত বলে তিনি মনে করেন।
সঞ্চালন ও বিতরণব্যবস্থায় পর্যাপ্ত বিনিয়োগ নেই
সরকারি হিসাবে, বিদ্যুতের সঞ্চালনব্যবস্থা উন্নত করতে ২ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা (৩১ বিলিয়ন ডলার, প্রতি ডলার ৮০ টাকা করে) বিনিয়োগ দরকার। এই বিশাল বিনিয়োগের এখন পর্যন্ত নিশ্চয়তা পায়নি বিদ্যুতের সঞ্চালনব্যবস্থার দায়িত্বে থাকা সরকারি প্রতিষ্ঠান পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)।
পিজিসিবি সূত্রে জানা গেছে, সঞ্চালন ও বিতরণব্যবস্থা উন্নত করতে ‘পাওয়ার গ্রিড নেটওয়ার্ক স্ট্রেনদেনিং প্রজেক্ট আন্ডার পিজিসিবি’ নামের প্রকল্পটি ২০১৬ সালের জুন থেকে শুরু হওয়ার কথা ছিল। এ প্রকল্পের আওতায় ৩৩ হাজার কিলোমিটার লাইন নির্মাণ, ৪৩টি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র নির্মাণ, ৫৩টি উপকেন্দ্রের সম্প্রসারণসহ বেশ কিছু উন্নয়ন পরিকল্পনা রয়েছে।
জানা গেছে, প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে চীনের উদ্যোগে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) কর্মসূচির আওতায় দেশটি ৯ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা ঋণ দেবে, বাকিটা দেবে সরকার। সরকারি পর্যায়ে চুক্তির পর কাজটি পেয়েছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ট্রিপল সি ইঞ্জিনিয়ারিং (সিসিসিই)। গত মাসে প্রকল্পটির ঋণ পাস হয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ আছে ২০২১ সাল পর্যন্ত। ফলে সময়মতো এ প্রকল্পের কাজ একটিমাত্র কোম্পানির পক্ষে শেষ করা সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, গত মার্চে পায়রার ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের নির্মাণকাজ শেষ হয়। এ কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি পরীক্ষার জন্য সেখানে একটি সঞ্চালন লাইন নির্মাণের দায়িত্বে ছিল পিজিসিবি। চলতি মাসেও লাইন স্থাপন করা যায়নি।
বিদ্যুৎ বিভাগের সূত্রমতে, বর্তমান প্রায় ১৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের সঙ্গে এ বছরেই যোগ হবে পায়রার ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট, পরের বছরেই আসবে এ কেন্দ্রের আরও ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট। এ ছাড়া ২০২২-২৪ সালের মধ্যে রামপাল ১ হাজার ৩২০, মাতারবাড়ী ২ হাজার ৪০০ ও রূপপুরের ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসবে। কিন্তু এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের যে লাইন, সেটি পিজিসিবি এই সময়ের মধ্যে স্থাপন করতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, দেশে ছয়টি বিতরণ সংস্থায় গ্রাহক হলো ৩ কোটি ৫০ লাখ। এদের মধ্যে ২ কোটি ৬০ লাখ গ্রাহক পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি)। আরইবির অঞ্চলে রয়েছে কম ভোল্টেজ সমস্যা। এ সমস্যার অন্যতম কারণ ট্রান্সফরমারগুলোর আওতায় যে পরিমাণ গ্রাহক থাকার কথা, তার চেয়ে বেশি রয়েছে। এর ফলে এগুলো বাড়তি লোডে চলছে।
বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনায় বলা হয়েছে, বিতরণব্যবস্থা উন্নত করতে ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা (৩৫ বিলিয়ন ডলার) প্রয়োজন। এই বিপুল পরিমাণ অর্থের জোগানের এখনো কোনো নিশ্চয়তা পায়নি বিদ্যুৎ বিভাগ।
এ পরিস্থিতিতে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম. তামিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের একটি বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনা আছে। কিন্তু এর বাইরে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দিচ্ছে। আসলে কি আমদানিনির্ভর বেশি দামের এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের আরও দরকার আছে? এই সরকারের বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী, বিদ্যুৎ-সচিব ও জ্বালানি উপদেষ্টার মধ্যে সমন্বয় নেই। এত দামের বিদ্যুৎ দেশের অর্থনীতি বহন করতে পারবে কি না, সেটি বিবেচনা করা হচ্ছে না। এটি অগ্রহণযোগ্য।’