লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে সাত লাখ টন কম সংগ্রহ করে এবারের মতো বোরো সংগ্রহে ইস্তফা দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। সংগ্রহের সময়কাল ১৫ দিন বাড়িয়েও খুব একটা লাভ হয়নি। তাই সময় আর না বাড়িয়ে যতটুকু সংগ্রহ হয়েছে, তাতেই সরকার খুশি বলে ঘোষণা দিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার।
নিজের নির্বাচনী এলাকা ও দেশের চাল ব্যবসার অন্যতম বড় কেন্দ্র নওগাঁয় গত বৃহস্পতিবার দেওয়া এক বক্তৃতায় মন্ত্রী বলেছেন, সরকারের চালের মজুত যথেষ্ট ভালো। কৃষকও ভালো দাম পাচ্ছেন। ফলে সরকার সফল হয়েছে। সাদাচোখে সবার খুশি হওয়ার এই বয়ানকে বাস্তবসম্মত বলেই অনেকের মনে হতে পারে। গুদামে থাকা ১২ লাখ টন চাল অবশ্য ভালো মজুত বলা যায়। তবে এই মজুতে অতি আত্মবিশ্বাসী হওয়া ঠিক হবে না। কারণ, এ বছর তিনটি দুর্যোগের ভেতর দিয়ে গেছে দেশ। করোনার কারণে কোটি মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। প্রাকৃতিক আরও দুর্যোগের আশঙ্কা রয়েছে। ফলে সরকারকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বেশিসংখ্যক গরিব মানুষকে লক্ষ্যমাত্রার বাইরে গিয়ে চালসহায়তা দিতে হতে পারে। ফলে সংগ্রহের ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ায় সামনে বড় ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বোরো মৌসুমে ১৬ লাখ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্য নিয়ে গত মে মাসে মাঠে নামা খাদ্য অধিদপ্তর নির্দিষ্ট সময়ে সংগ্রহ করতে পেরেছে আট লাখ টনের মতো। বাধ্য হয়ে গত ৩০ আগস্ট সংগ্রহের সময় ১৫ দিন বাড়ানো হয়। এই সময় পেরিয়ে যাওয়ায় দেখা গেছে, ৯ লাখ টনের সামান্য কিছু বেশি চাল সংগ্রহ করা গেছে।
বাজারে এখন মোটা চালের যে দাম (প্রতি কেজি ৪২–৪৮ টাকা, খুচরা বাজারে) তা অন্তত গরিব মানুষের দিক থেকে বিবেচনায় নিলে ভালো বলা মুশকিল। আবার, বাজারে ধান–চালের দাম বেশি হওয়ায় কৃষক ভালো দাম পাচ্ছেন বলে যে তৃপ্তির ঢেকুর তোলা হচ্ছে, সেটি কতটুকু আসল আর কতটুকু ভ্রান্তি, তা–ও দেখার বিষয়। খাদ্যনীতিবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইফপ্রি) সম্প্রতি বাংলাদেশে বোরো ধানের উৎপাদন, দাম ও বণ্টন এবং সংগ্রহ নিয়ে একটি গবেষণা করেছে। তাতে দেখা গেছে, বোরো ধান মে থেকে জুন মাসের মধ্যে কাটা হয়ে যায়। আর চাষিদের হাত থেকে আগস্টের মধ্যে বেশির ভাগ ধান ফড়িয়া, চালকলমালিক ও ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যায়। আর তখন থেকেই ধান–চালের দাম বাড়তে থাকে। ফলে তখন এর সুফল চাষিরা আর পান না।
এই অবস্থায় যুগের পর যুগ দেশের ধান–চাল সংগ্রহ নিয়ে যেসব কাণ্ডকারখানা হয়ে গেছে, তা–ও একটু স্মরণ করা যেতে পারে। দেশে ধান–চালের উৎপাদন, ভোগ, আমদানি ও রপ্তানির তথ্য নিয়ে যে বিভ্রাট আছে, আগের মতো এবারও প্রমাণিত হলো। এমনিতে তো চালের উৎপাদন নিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একেক রকমের তথ্য তো আছেই। আবার চালের দাম নিয়ে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি), কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ভিন্ন ভিন্ন তথ্যের বিভ্রান্তি কাটানোর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সব মিলিয়ে দেশের ধান–চালের উৎপাদন, দাম ও ভোগের কোনো একক হিসাব না থাকায় ধান–চাল নিয়ে সরকারের নীতি ও পরিকল্পনাকে বিপদে ফেলেছে।
২০১৭ সালে হাওরে আগাম বন্যার কারণে বোরো ফসলের ক্ষতির বিষয়টি অনেকের মনে থাকার কথা। কৃষি মন্ত্রণালয় বলল, এতে ক্ষতি হয়েছে ছয় লাখ টন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় বলল, ক্ষতি ১০ থেকে ১২ লাখ টন। হিসাবের এই গরমিলের মধ্যেই শুল্ক কমিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ২ বছরে প্রায় ৭০ লাখ টন চাল আমদানির সুযোগ দিল। এর ফল হচ্ছে ২০১৯–এর মার্চ পর্যন্ত দেশের বেশির ভাগ কৃষককে উৎপাদন খরচের অর্ধেক দামে ধান বিক্রি করতে হয়েছে।
এর আগে ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত একই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। ওই সময়ে গড়ে (প্রতিবছর) ২০ থেকে ৩০ লাখ টন করে চাল আমদানি হয়েছে। অন্যদিকে জাতীয় সক্ষমতা দেখাতে ওই সময়ে শ্রীলঙ্কায় ৫০ হাজার টন চাল রপ্তানি করেছে সরকার।
সস্তায় জনগণকে চাল খাওয়াব—এই রাজনৈতিক স্লোগানে বলীয়ান হয়ে কৃষককে ন্যায্যমূল্য থেকে বছরের পর বছর বঞ্চিত রাখা হয়েছে। তাই এবার বোরো সংগ্রহের শুরুতেই কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে বলা হলো, কৃষককে ন্যায্যমূল্য দিতে সরাসরি তাঁদের কাছ থেকেই ধান কেনা হবে। প্রতিটি উপজেলায় ধান রাখার গুদাম নির্মাণেরও প্রকল্প নেওয়া হলো। কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কিনতে তৈরি করা হলো বিশেষ অ্যাপ। কিন্তু এপ্রিল পেরিয়ে মে আসতেই সব আশায় যেন গুড়েবালি হয়ে গেল। সরকারের বেঁধে দেওয়া মূল্যের চেয়ে ধানের বাজারদর বেড়ে গেল। এতে বেশির ভাগ কৃষক সরকারের কাছে ধান বেচতে আগ্রহী হলেন না। এর মধ্যে হানা দিল করোনা। সংক্রমণ না কমতেই ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাত। তারপর তো দুই মাস বন্যায় ডুবল দেশের এক–তৃতীয়াংশ এলাকা। আমনের বীজতলা নষ্ট হলো। আর এর মধ্যে ধানের দাম আরও গেল বেড়ে।
জুন থেকেই চালকলমালিকেরা বলা শুরু করলেন, সংগ্রহমূল্য না বাড়ালে সরকারি গুদামে তাঁরা চাল দিতে পারবেন না। কৃষকেরাও সরকারি দামে ধান দেওয়া বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু তাতেও সরকারের টনক নড়ল না। সেই পুরোনো পথেই হাঁটা শুরু করল সরকার। চালকলমালিকদের ধমক, অনুরোধ ও হুমকি সবই দেওয়া হলো। চালকলমালিকেরাও অবশ্য এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। ধান–চালের দাম বাড়লে তাঁদের মুনাফা বাড়বে, ফলে সরকারি গুদামে চাল না দিয়ে বাজারে বিক্রি করলেই বেশি মুনাফা। এর বিনিময়ে একটু ‘মিষ্টি ধমক’ না হয় খেলোই–বা।
ইফপ্রি ও দেশের অর্থনীতিবিদেরা এই অবস্থার মধ্যেই সরকারকে নানা পরামর্শ দিয়েছেন। বিদেশ থেকে নয়, চালকলমালিকদের সঙ্গে চুক্তি করেও নয়, অভ্যন্তরীণ দরপত্রের মাধ্যমে চাল সংগ্রহ বৃদ্ধি করতে বলেছেন তাঁরা। দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে চাল আছে, কিন্তু তা কার কাছে, তা খুঁজে বের করতে সরকারকে উদ্যোগী হতে বলেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেন সরকারকে এ নিয়ে আলাদা করে পরামর্শ দিতে হবে। সরকারের তো মজুতবিষয়ক আইন আছে। সেটি ২০১২ সালে হালনাগাদ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, প্রতি সপ্তাহে কার কাছে কী পরিমাণ চাল আছে, তার হিসাব সরকারকে দিতে হবে। কিন্তু সেই আইন ‘কাজির গরুর’ মতো। কাগজে আছে, গোয়ালে নেই। ফলে সেই সুযোগই নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
এই পরিস্থিতির মধ্যেই খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে আচমকা ঘোষণা এল, তারা চাল আমদানির দিকে এগোবে। সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে তারা এর অনুমোদনও নিয়ে রাখল। কিন্তু চাল আমদানির অতীত অভিজ্ঞতা বলে, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ যখনই চাল কেনা শুরু করে, তখনই দাম বেড়ে যায়। এবারও তাই হলো। গত আগস্টে বাংলাদেশ আমদানির ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারত, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডসহ প্রধান রপ্তানিকারক দেশগুলো দাম বাড়িয়ে দিল। এক মাসের মাথায় প্রতি কেজি চালের দাম চার থেকে ছয় টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেল। গত বৃহস্পতিবারে বিশ্ববাজারে মোটা চালের দাম প্রতি কেজি ৪৬ টাকায় পৌঁছাল। অর্থাৎ দেশের আর বিশ্ববাজারে চালের একই দর হয়ে গেল। আমদানিপ্রক্রিয়া শুরুর পর থেকে দেশে চাল আসতে আসতে আরও মাসখানেক লেগে যাবে। এর মধ্যে দাম আরও বাড়তে পারে। অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চাল আমদানি করতে গিয়ে বাংলাদেশকে অনেক চড়া মূল্য দিতে হয়েছে। প্রতি টন চাল ২৫০ ডলারে চুক্তি করে শেষ পর্যন্ত তা ৫০০ ডলারে নিতে হয়েছে। চাল নিয়ে সর্বোচ্চ কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হয়েছে বাংলাদেশকে। এবারও চাল নিয়ে কোন ‘চালে’ সরকারকে পড়তে হয়, সেটা হয়তো ভবিষ্যৎই বলে দেবে।
তবে চাল নিয়ে সরকারের নীতিতে ভুল হলে দেশের এক কোটি কৃষক ও চার কোটি গরিব মানুষের ভোগান্তি বাড়বে, সেটি নিশ্চিত করেই বলা যায়। খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ নামে সরকারের একটি ইউনিট রয়েছে। এই ইউনিটকে পরামর্শ দিতে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের নিয়ে একটি জাতীয় কমিটি আছে। খাদ্য ব্যবস্থাপনা, নীতি ও উৎপাদন নিয়ে কাজ করা বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাও দেশে কাজ করছে। সবাইকে নিয়ে দ্রুত একটি মূল্যায়ন সভা করা জরুরি। সবার পরামর্শ না নিয়ে একক কোনো মন্ত্রণালয় বা ব্যক্তির সিদ্ধান্ত নিলে বিপদ বাড়বে। সব সিদ্ধান্তেই শুধু সফলতা দেখা বা তৃপ্তির ঢেকুর তোলা কাজের কথা হতে পারে না।