চালকের পরীক্ষা নিতে ৭০০ গাড়ি কিনতে চায় বিআরটিএ
চালকের পরীক্ষা নিতে বিভিন্ন ধরনের ৭০০ যানবাহন কেনার প্রকল্প হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিজে যানবাহন কিনে চালকের পরীক্ষা নেওয়ার এই প্রকল্প ফলপ্রসূ হবে না, বরং এসব যানবাহন পরে প্রতিষ্ঠানের বোঝা হয়ে উঠবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই পরীক্ষা মনোনীত ড্রাইভিং স্কুলের মাধ্যমে তাদের গাড়ি ব্যবহার করে হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের মোটরযান আইন অনুসারে, লাইসেন্স পেতে হলে প্রথমে চালককে লিখিত পরীক্ষা দিতে হয়। এরপর ফিল্ড টেস্ট (চালিয়ে দেখানো) দিতে হয়। আইনে বলা আছে, নিজস্ব যানবাহন সঙ্গে নিয়ে এসে পরীক্ষার্থীকে চালিয়ে দেখাতে হবে। আইনের এই বাধ্যবাধকতাকে অবাস্তব বলছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ, সব চালকের নিজস্ব গাড়ি থাকার সুযোগ নেই। আবার নিজস্ব যান এনে পরীক্ষার স্থলে রাখার পর্যাপ্ত জায়গাও কর্তৃপক্ষের নেই।
এই অবস্থায় বিআরটিএ কার্যালয়গুলোয় অল্প সময়ের জন্য মোটরসাইকেল, বাস-পিকআপসহ সব ধরনের যান ভাড়া দেওয়ার বাণিজ্য চালু হয়েছে। কয়েক মিনিটের জন্য একজন পরীক্ষার্থীকে দেড় থেকে দুই শ টাকা ভাড়া গুনতে হয়। এই ভাড়া-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করেন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। এর সঙ্গে বিআরটিএর একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীও যুক্ত আছেন। গত জানুয়ারি ও এপ্রিলে দুই দফা বিআরটিএর বিভিন্ন কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দল যানবাহন ভাড়া দিয়ে পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো টাকা আদায়ের ঘটনা দেখতে পায়।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, দুদক কয়েকবার অভিযান চালানোর পর বিআরটিএর কর্মকর্তাদের মধ্যে কিছুটা আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এরপর বিআরটিএর ঢাকা জেলা সার্কেল চালকের পরীক্ষার জন্য নিজস্ব যানবাহনের ব্যবস্থা করতে বিআরটিএর প্রধান কার্যালয়ে চিঠি দেয়। সেই সূত্র ধরে বিআরটিএর চেয়ারম্যান গত মার্চে চালকের পরীক্ষার জন্য নিজস্ব যানবাহন চালু করার বিষয়ে মতামত চেয়ে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেন। মন্ত্রণালয় গাড়ি কেনার বিষয়ে একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি করার পরামর্শ দেয়।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ পেয়ে বিআরটিএ একটি ডিপিপি তৈরির কাজ করছে। প্রাথমিকভাবে ৭০৪টি বিভিন্ন শ্রেণির যানবাহন কেনার প্রস্তাব করেছে তারা। এর মধ্যে ১৩৬টি করে মোটরসাইকেল ও অটোরিকশা এবং কার, মাইক্রোবাস, মিনিবাস, মিনিট্রাক, বাস ও ট্রাকের প্রতিটি শ্রেণির ৭২টি করে কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বিআরটিএ পরীক্ষার ফির সঙ্গে গাড়ি ব্যবহারের ফি যুক্ত করে তা পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে আদায় করবে।
বিআরটিএর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কোরিয়ার সহায়তা সংস্থা কোইকা বিআরটিএকে যানবাহনের ফিটনেস যাচাইয়ের যন্ত্র দিয়ে সহায়তা করেছে। কোইকা ছাড়াও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থার কাছ থেকে এই প্রকল্পের জন্য অর্থ সহায়তা নেওয়ার চেষ্টা করবেন তাঁরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএর চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, লাইসেন্স পরীক্ষা দিতে আসা মানুষদের গাড়ি সরবরাহ করে মধ্যস্বত্বভোগীরা। এতে বিআরটিএর বদনাম হচ্ছে। তাই নিজেরা গাড়ি কিনতে বিআরটিএর কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি কমিটি করা হয়েছে। গাড়ি কেনার ব্যয় এবং কীভাবে তা পরিচালনা করা হবে, তা ঠিক করতে কাজ করছে কমিটি। তাঁর মতে, বিআরটিএ বছরে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ফি আদায় করছে। সরকার তো আয় করছে। ফলে গাড়ি কিনে সেবা দেওয়া গেলে তো ভালো।
>ঢাকাসহ মহানগরগুলোতে দৈনিক ৪৫০ চালক পরীক্ষায় অংশ নেন
জেলাগুলোতে পরীক্ষায় অংশ নেন ১৫০ জন
বিআরটিএ অনুমোদিত ড্রাইভিং স্কুলের সংখ্যা ১২৮
গাড়ি কিনলে তা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা
গাড়িগুলো পরে বোঝা হয়ে উঠতে পারে
গাড়ি কিনলে সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হওয়া এবং অপব্যবহারের আশঙ্কা সম্পর্কে বিআরটিএর চেয়ারম্যান বলেন, ঢাকা ও চট্টগ্রামে গাড়ি বেশি লাগবে। আর সারা দেশের কার্যালয়গুলোতে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। ফলে রক্ষণাবেক্ষণে সমস্যা হবে না। অপব্যবহারও হবে না।
তবে বিআরটিএ সূত্র বলছে, বিআরটিএতে লোকবল কম। প্রতিষ্ঠানটির বেশির ভাগ কার্যালয়েরই নিজস্ব জায়গা নেই। বিআরটিসির ডিপো, জেলা প্রশাসনের ক্যাম্পাসে কিংবা ছোট পরিসরে নিজস্ব ভবনে কার্যালয় চালায় তারা। ফলে বিপুল এই যানবাহন রাখা এবং রক্ষণাবেক্ষণ করা একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অল্পদিনের মধ্যেই যানবাহনগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা যেমন আছে, তেমনি এসব গাড়ি কর্মকর্তা নিজেদের মতো ব্যবহারের জন্য নিয়ে যেতে পারেন বলেও মনে করা হচ্ছে। ফলে প্রকল্পটি কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত এটি একটি ‘কেনাকাটার প্রকল্পে’ পরিণত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, ঢাকায় জোয়ারসাহারা বিআরটিসির বাস ডিপো, উত্তরায় ও কেরানীগঞ্জের ইকুরিয়ায় বিআরটিএ কার্যালয়ে প্রতিদিন পেশাদার ও অপেশাদার চালকের লাইসেন্সের পরীক্ষা হয়। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম কার্যালয়েও প্রতিদিন পরীক্ষা হয়। আর অন্য জেলা শহরে মাসে দুই বা তার বেশিবার পরীক্ষা হয়। বিআরটিএর হিসাবে, বর্তমানে ঢাকাসহ মহানগরগুলোতে দৈনিক প্রায় সাড়ে ৪০০ চালক পরীক্ষায় অংশ নেন। জেলাগুলোতে অংশ নেন ১৫০ জন। এর মধ্যে মোটরসাইকেলের চালকদের কারও কারও নিজের বাহন থাকে। বাকি প্রায় ৫০০ পরীক্ষার্থীই ভাড়া করা গাড়িতে পরীক্ষা দেন। প্রতিটি গাড়ি ভাড়া বাবদ গড়ে ১৫০ টাকা ধরলে দিনে প্রায় ৭৫ হাজার টাকা দিতে হয় পরীক্ষার্থীদের।
বিআরটিএর কর্মকর্তারা বলছেন, মোটরগাড়ির লাইসেন্সের জন্য যাঁরা পরীক্ষা দেন, তাঁদের ৮০ শতাংশেরই নিজস্ব গাড়ি নেই। বাস-ট্রাকের পরীক্ষা দেওয়া ব্যক্তিরা চাইলেই মালিকের কাছ থেকে ওই যান নিয়ে আসতে পারবেন না। অনেকে বিদেশে যাওয়ার আগে লাইসেন্স সংগ্রহের জন্য পরীক্ষা দেন। তাঁদেরও গাড়ি থাকে না। ফলে আইনে গাড়ি নিয়ে আসার বাধ্যবাধকতা বাস্তবে অকার্যকর। আর সবাই গাড়ি নিয়ে এলে এর জায়গা দেওয়াও সম্ভব নয়। আইন ও বাস্তবতার এই মারপ্যাঁচের কারণে যানবাহন ভাড়ার ব্যবসা চলছে।
বিআরটিএ নির্দিষ্ট পরিমাণ ফি নিয়ে ড্রাইভিং স্কুলের অনুমোদন দিয়ে থাকে। এ পর্যন্ত সংস্থাটির অনুমোদিত ড্রাইভিং স্কুলের সংখ্যা ১২৮। কিন্তু এগুলো চালক তৈরি বা পরীক্ষায় সহায়তা দেওয়ার মতো সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ড্রাইভিং স্কুলগুলোকে কার্যকর করে বিআরটিএ চলমান সমস্যার সমাধান করতে পারে। কিন্তু তারা সে পথে না গিয়ে যাচ্ছে কেনাকাটার পথে। কেনাকাটার পর লাগবে দীর্ঘ মেয়াদি রক্ষণাবেক্ষণের খরচ।
এ বিষয়ে পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে লাইসেন্স দেওয়ার পদ্ধতিতেই গলদ আছে। লাইসেন্স দেওয়া হয় রাস্তায় চালানোর জন্য। আর বিআরটিএ তাদের কার্যালয়ে সামান্য একটু চালিয়ে পরীক্ষা নেয়। বিশ্বব্যাপী নিয়ম হচ্ছে শিক্ষানবিশ চালক অবশ্যই অনুমোদিত কোনো ড্রাইভিং স্কুল থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে পরীক্ষায় অংশ নেবেন। পরীক্ষার সময় ইনস্ট্রাক্টর পরীক্ষার্থীর সঙ্গে থাকবেন। গাড়ি সরবরাহ করবে ড্রাইভিং স্কুল। তিনি বলেন, সরকার গাড়ি কিনে পরীক্ষা নিতে গেলে রক্ষণাবেক্ষণে বিপুল খরচের বোঝা পড়বে প্রতিষ্ঠানের ওপর।