দেশের ভেতর থেকে চাল সংগ্রহ আর বিদেশ থেকে আমদানি—সরকারের দুই লক্ষ্যই এখনো পূরণ হয়নি। মোটা চালের দাম এখনো সহনীয় পর্যায়ে আসেনি। আর দরিদ্র মানুষের জন্য খোলাবাজারে চাল বিক্রি (ওএমএস) কর্মসূচিও ঝিমিয়ে পড়েছে। সরকারের অনেক উদ্যোগের পরও চাল নিয়ে দুশ্চিন্তা কাটছে না।
দেশের চালকলমালিকদের কাছ থেকে চাল পাওয়ার সম্ভাবনা কম। তারপরও বোরোতে সরকারের সংগ্রহ অভিযানের মেয়াদ তৃতীয় দফায় বেড়েছে। নভেম্বর মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত চাল সংগ্রহ করবে সরকার। এর আগে সংগ্রহের সময় দুই দফা বাড়ানো হয়েছিল, তাতেও খুব একটা লাভ হয়নি। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সব মিলিয়ে সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ২ লাখ ৯২ হাজার টন চাল। আর সরকারের চালের মোট মজুত যেখানে ৮ থেকে ১০ লাখ টন থাকার কথা, সেখানে গত ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত ছিল ৪ লাখ ৪ হাজার টন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) বিশেষ ফেলো এম আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, চাল সংগ্রহে শুরু থেকেই খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দূরদর্শিতার অভাব ও পরিকল্পনাহীনতা ছিল। ফলে চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছিল। আমদানি বাড়ায় দাম কিছুটা কমেছে, কিন্তু বন্যায় আমনের ক্ষতির কারণে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ধানের উৎপাদন না-ও হতে পারে। আর অনেক চেষ্টার পরও চালের দাম এখনো সহনীয় পর্যায়ে আসছে না।
দেশের ভেতর থেকে চাল সংগ্রহে ব্যর্থ হয়ে পাঁচ দেশের সঙ্গে চাল আমদানির চুক্তি করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। ১৬ লাখ টনের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে মাত্র এসেছে ৪ লাখ ৩৬ হাজার টন। এর মধ্যে সরকারি গুদাম থেকে প্রতি মাসে রোহিঙ্গাদের জন্য যাচ্ছে প্রায় ১৭ হাজার টন চাল। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) ওই চালের মূল্য পরে পরিশোধ করবে, এমন ঘোষণা দিলেও বর্তমান নাজুক মজুতে তা বাড়তি চাপ ফেলছে।
অন্যদিকে খাদ্যমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, মিয়ানমার থেকে আমদানি হওয়া ১ লাখ টন চালের পুরোটাই রোহিঙ্গাদের খাবার হিসেবে তাদের ক্যাম্পে বিতরণ করা হবে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে আমদানি হওয়া ওই চাল সরকারি গুদামে আর যাচ্ছে না। কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড ও ভারতের সঙ্গে চাল আমদানির চুক্তি করলেও তা আসার গতি ধীর। ফলে সরকারি গুদামে চালের মজুত গত চার মাসেও ৪ লাখ টনের ওপরে যেতে পারেনি। ১৭ লাখ টন ধারণক্ষমতার গুদামগুলোর বেশির ভাগই ফাঁকা পড়ে আছে।
এ পরিস্থিতি সত্ত্বেও খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম মনে করেন, দেশে চালের দাম নিয়ে আর কোনো সংকট নেই। দাম অনেক কমেছে, সামনে আরও কমবে। ডিসেম্বরে আমন ধান উঠবে, আর বিদেশ থেকেও সব চাল এসে যাবে। তখন দাম অনেক কমে যাবে। মিয়ানমার থেকে আমদানি করা চাল শুধু রোহিঙ্গাদের দেওয়া হলে সমস্যা নেই। তিনি বলেন, আগামী মাসের মধ্যে গুদামে চালের পরিমাণ ৫ লাখ টন হবে। তখন আর কোনো সমস্যা থাকবে না।
গত সপ্তাহে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) রাইস মনিটর রিপোর্ট অক্টোবর-২০১৭ প্রকাশ করেছে। তাতে বাংলাদেশে আমন মৌসুমে দুই দফা বন্যায় ফসলহানির চিত্র তুলে ধরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে চাহিদা মেটাতে হলে আমদানির ওপর ভরসা করতে হবে। আর বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি খাতের হঠাৎ এই বিপুল আমদানি আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দামও বাড়িয়ে দিয়েছে বলে জাতিসংঘের এই সংস্থাটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের চালের দাম এখনো অন্য যেকোনো বছরের চেয়ে বেশি আছে বলে এফএওর ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। একে বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক দরিদ্র মানুষের খাদ্যনিরাপত্তার জন্য একটি সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে সংস্থাটি।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের গত ৩০ অক্টোবরের দৈনিক খাদ্যশস্য প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে মোটা চাল এখনো ৪৪ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আরেক সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে গতকাল শুক্রবার মোটা চালের কেজি ছিল ৪৪ থেকে ৪৬ টাকা। আর চিকন চালের দাম ৫৮ থেকে ৬৫ টাকা। সরকারি এই দুটি সংস্থার হিসাবে গত এক মাসে মোটা চালের দাম ১ থেকে ২ শতাংশ কমেছে। অবশ্য গত মে মাসে মোটা চালের দাম কেজিপ্রতি ৪৮ টাকায় উঠেছিল, যা বিশ্বে রেকর্ড।
দেশের বেশির ভাগ এলাকার মানুষ আতপ চাল খায় না। কিন্তু খোলাবাজারে চাল বিক্রিসহ (ওএমএস) সরকারের বেশির ভাগ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে আতপ চাল দেওয়া হচ্ছে। কারণ হিসেবে খাদ্য অধিদপ্তর বলছে, তাদের কাছে সেদ্ধ চাল কম আছে। বিদেশ থেকে আমদানি হওয়া চালের বেশির ভাগ আতপ চাল। ফলে ওই কর্মসূচিগুলোতে আতপ চাল দেওয়া হচ্ছে।
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার ওএমএস ডিলাররা বারবার আতপ চাল নিয়ে আপত্তি জানালেও তা আমলে নেওয়া হয়নি। ক্রেতারা আতপ চালের পরিবর্তে সেদ্ধ চাল চাইলেও খাদ্য অধিদপ্তর থেকে ওএমএসে আতপ চালই দেওয়া হচ্ছে।
ফলে ওএমএসে চাল বিক্রির পরিমাণ ধারাবাহিক হারে কমছে। গত সেপ্টেম্বরে রাজধানীতে ওএমএসে চাল দেওয়া হতো প্রতিদিন ১ হাজার ৬০০ টন। এক সপ্তাহ ধরে তা কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে ১ হাজার ৪০০ টন। দেশের বেশির ভাগ এলাকায় ডিলারের সংখ্যাও কমে গেছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ডিলারদের ট্রাকের সামনে ক্রেতাদের সংখ্যাও কম দেখা গেছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ এম এম শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, চালের দাম ৪৪ থেকে ৪৫ টাকার মধ্যে থাকলে তা মধ্যবিত্তের জন্য বড় কোনো সমস্যা নয়। কিন্তু দেশের কয়েক কোটি হতদরিদ্রের জন্য এটা বড় ধরনের সংকট তৈরি করার কথা। এ ধরনের পরিস্থিতিতে বাজারে চাল থাকে, কিন্তু তা কেনার মতো ক্ষমতা অনেকের থাকে না। ফলে তারা ভাত খাওয়ার পরিমাণ কমিয়ে দেয়। এমন পরিস্থিতি দেশে হচ্ছে কি না, তা সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর খতিয়ে দেখা উচিত। কেননা, এমন পরিস্থিতি দীর্ঘমেয়াদি হলে দেশের বিশাল একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে অপুষ্ট প্রজন্ম তৈরি করবে।