চার সিবিএ নেতার অঢেল সম্পদ!
দুই সরকারি প্রতিষ্ঠানের চার সিবিএ (কালেকটিভ বার্গেনিং এজেন্ট) নেতার অঢেল সম্পদের খোঁজ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে সংস্থাটি।
তাঁরা হলেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) সিবিএ সভাপতি আবুল হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম এবং বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সিবিএ সভাপতি মো. জহিরুল ইসলাম চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক মো. আলাউদ্দিন মিয়া। নিয়োগ-বদলি, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ ও বেনামে ঠিকাদারি ব্যবসাসহ নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত বিপুল সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে।
দুদক সূত্র জানিয়েছে, এর মধ্যে প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষ করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে সম্পদের হিসাব চাওয়া হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁদের দুদকে তলবও করা হয়েছে।
তবে তাঁদের সবাই বলেন, সিবিএর নেতৃত্ব থেকে সরাতে বিএনপি-জামায়াতের লোকজনই তাঁদের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন এসব অভিযোগ করেছেন।
পিডিবির দুই নেতার সম্পদের পাহাড়!
পিডিবির সিবিএ সভাপতি জহিরুল ইসলাম চৌধুরী সংস্থার সাবেক সহকারী হিসাবরক্ষক। সাধারণ সম্পাদক মো. আলাউদ্দিন সাবেক স্টেনো টাইপিস্ট। তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হয়েও তাঁরা সংস্থার যুগ্ম সচিব মর্যাদার কর্মকর্তাদের ব্যবহারযোগ্য পাজেরো গাড়ি ব্যবহার করতেন। অবসরে যাওয়ার দীর্ঘদিন পরও গাড়ি দুটি তাঁদের দখলে ছিল। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে দুদক ওই গাড়ি দুটি তাঁদের দখল থেকে উদ্ধার করে পিডিবির পরিবহন পুলে জমা দেয়। ওই সময় দুদক জানিয়েছিল, এ দুজনের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ আছে। ক্ষমতার অপব্যবহার ও সরকারি সম্পত্তি আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের সহকারী পরিচালক খলিলুর রহমান ১৭ এপ্রিল জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁদের দুদকে তলব করেছেন।
তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, অনেক দিন ধরে সিবিএর নেতৃত্বে থেকে বোর্ড প্রশাসনের ওপর খবরদারি ও অনিয়মের মাধ্যমে বিপুল সম্পদ অর্জন করেছেন।
দুদকে আসা অভিযোগে বলা হয়, সিবিএ সভাপতি জহিরুল ইসলাম চৌধুরী তেজগাঁওয়ের বেগুনবাড়ি অফিসার্স কোয়ার্টারে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদের জন্য নির্ধারিত এ ক্যাটাগরির একটি বাসা ১০ বছর ধরে নিজ দখলে রেখে সরকারের লাখ লাখ টাকা ক্ষতি করেছেন। পিডিবির ভলিবল কোচ হিসেবে প্রতিবছর তিন লাখ টাকার অতিরিক্ত সুবিধা নিয়ে সংস্থার আর্থিক ক্ষতি করেছেন। দক্ষিণ বাড্ডা আফতাব নগরের উত্তর পাশে (আনন্দ নগরে) ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে পাঁচতলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের ফতেপুরে তিনতলা ডুপ্লেক্স বাড়ি নির্মাণ ও একটি ইটভাটা করেছেন। রাজধানীর কুড়িলে একটি কারখানা রয়েছে তাঁর।
দুদকের তথ্যমতে, মেসার্স সরকার এন্টারপ্রাইজ নামে যৌথভাবে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে জহিরুল ইসলামের, যার মূলধন কমপক্ষে ৫০ কোটি টাকা। ফার্মগেটের সেজান পয়েন্টে দ্বিতীয় তলায় ছোট ভাই শরিফ চৌধুরীর নামে দুটি দোকান কিনেছেন তিনি। রাজধানীর বাসাবোতে পাটোয়ারী গলির পাশে একটি দামি প্লট আছে। আফতাব নগর পিজিসিবি অফিসের কাছে বিভিন্ন নামে ২৮ কাঠা জমি কিনেছেন তিনি। গুলশান ও মোহাম্মদপুরে রয়েছে দুটি ফ্ল্যাট। শেরপুরে কয়েক বিঘা জমির ওপর কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে যৌথভাবে বাগানবাড়ি তৈরি করেছেন। রংপুরে যৌথ মালিকানায় রয়েছে মেসার্স সরকার ফিলিং স্টেশন। বিভিন্ন ব্যাংকে স্ত্রী-সন্তান ও নিজ নামে রয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জহিরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘১০ বছর ধরে দুদকে আমার বিরুদ্ধে নিয়মিতভাবেই অভিযোগ আসছে, যার কোনো ভিত্তি নেই।’ যেসব অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে, সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বেগুনবাড়ির বাসাটি তিনি আন্তর্জাতিক ভলিবল কোচ হিসেবে বরাদ্দ পেয়েছেন। তিনি জানান, আনন্দ নগরে সাড়ে ৪ শতাংশ জমি আছে চারজনের নামে। আর আছে কিছু পৈতৃক সম্পদ। এর বাইরে অবৈধ কোনো সম্পদ নেই। তাঁর দাবি, সব সম্পদের তথ্য আয়কর বিভাগে আছে। দুদককেও কয়েকবার দিয়েছেন।
দুদকের থাকা অভিযোগের তথ্যমতে, সিবিএর সাধারণ সম্পাদক মো. আলাউদ্দিনেরও রয়েছে বিপুল সম্পদ। রাজধানীর রাজারবাগের মোমেনবাগে দোলনচাঁপা অ্যাপার্টমেন্টে তাঁর আছে কোটি টাকার বেশি দামের ফ্ল্যাট। শরীয়তপুরের পালং থানার স্বর্ণঘোষ গ্রামে তিনি নির্মাণ করেছেন ডুপ্লেক্স বাড়ি। রাজধানীর শ্যামপুরের শাহজালালবাগে আছে ছয় কাঠার প্লট। জুরাইন চেয়ারম্যানবাড়ি এলাকায় পাঁচ কাঠা জমির ওপর আছে টিনশেড বাড়ি। মাতুয়াইলের সাদ্দাম মার্কেট এলাকায় তুষারধারা আবাসিক প্রকল্পে আছে দুটি প্লট। গ্রামের বাড়িতে কিনেছেন বিপুল পরিমাণ জমি। স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়ের নামে জনতা ব্যাংক ওয়াপদা শাখা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক , ইসলামী ব্যাংকের দিলকুশা শাখা, শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক দিলকুশা শাখা, ইস্টার্ণ ব্যাংকের জীবন বীমা ভবন শাখা, সোনালী ব্যাংকের শরীয়তপুর শাখা, জনতা ব্যাংকের রাজারবাগ শাখা ও জনতা ব্যাংকের বায়তুল মোকাররম শাখায় বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা আছে। আল ইমরান এন্টারপ্রাইজ, আলী অ্যান্ড বসির এন্টারপ্রাইজ ও আল আমিন এন্টারপ্রাইজ নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যবসা করছেন তিনি। এ ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে শিক্ষাগত সনদ জালিয়াতি করে অতিরিক্ত কয়েক বছর চাকরি করে সরকারের মোটা অঙ্কের টাকা ক্ষতি করার অভিযোগ আছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে মো. আলাউদ্দিন মিয়ার ফোনে বহুবার যোগাযোগ করলেও পাওয়া যায়নি।
বিআইডব্লিউটিএর দুই নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়:
বিআইডব্লিউটিএর সিবিএ সভাপতি আবুল হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে যেসব সুনির্দিষ্ট অভিযোগ, তার সপক্ষে সংশ্লিষ্ট নথিপত্রও পাওয়া গেছে। প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণ নিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক।
গত ১৩ ফেব্রুয়ারি রফিকুল ইসলামকে সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়ার জন্য নোটিশ দেওয়া হয়। নোটিশে তাঁদের পরিবারের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ও পরিবারের সদস্যদের সব সম্পদ, ব্যাংক হিসাবসহ ১২ ধরনের তথ্য চাওয়া হয়। পাশাপাশি তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৪ এপ্রিল তলব করা হলেও তিনি দুদকে হাজির হননি। আবুল হোসেনও তাঁর সম্পদের হিসাব জমা দিয়েছেন।
দুদকে আসা তথ্যমতে, সিবিএর সাধারণ সম্পাদক ও নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরের টোল আদায়কারী রফিকুল ইসলাম নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লার মাসদাইর মৌজায় ৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ বাড়ি কিনেছেন। ফতুল্লা সাবরেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে রেজিস্ট্রি হওয়া দলিলে (নম্বর ১০৯৪৪) পাকা ভবনসহ জমির দাম দেখানো হয় ৮৫ লাখ টাকা। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ভবনসহ ওই জমির প্রকৃত বাজারমূল্য ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এর বাইরে মানিকগঞ্জের শিবালয়ের তেওতা মৌজায় তিন পর্যায়ে মোট ৮৬ শতাংশ জমি কেনেন। এসব জমির দাম প্রায় ১০ কোটি টাকা। এর বাইরে তাঁর গাড়িও আছে একটি।
রফিকুল ইসলামের স্ত্রী শাহীদা বেগম গৃহিণী হলেও তিনি নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যার তীরে ‘মেসার্স ইব্রাহিম ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ’ নামের একটি ডকইয়ার্ডের মালিক। এই ডকইয়ার্ড তৈরির জন্য বিআইডব্লিউটিএ থেকে তাঁর নামে ২০ কাঠা জমি ইজারা নেওয়া হয়। ছেলে মোহাম্মদ ইব্রাহিম হোসাইনের নামে নারায়ণগঞ্জের গন্ধাকুল এলাকায় মেসার্স ইব্রাহিম ইঞ্জিনিয়ারিং ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ওয়ার্কশপ নামে আরেকটি ডকইয়ার্ড আছে। এটি নির্মাণের জন্য ইজারা নেওয়া হয় ছয় হাজার বর্গফুট জমি। আইন অনুসারে বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তা-কর্মচারী বা তাঁদের নিকটাত্মীয়দের নামে নদীতীরের জায়গা ইজারা দেওয়ার বিধান নেই। এ ছাড়া কর্তৃপক্ষের ওপর প্রভাব বিস্তার করে মেজ ছেলে ওমর ফারুককে বিআইডব্লিউটিএতে মার্কম্যান পদে চাকরি দিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে।
জানতে চাইলে রফিকুল ইসলাম অবৈধ সম্পদ অর্জনের কথা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, দুদকে সব সম্পদের হিসাব জমা দিয়েছেন। এরপরও তাঁকে দুদকে তলব করায় চেয়ারম্যান বরাবর চিঠি দিয়ে হাজির হননি।
সিবিএ সভাপতি আবুল হোসেন প্রভাব খাটিয়ে তাঁর জামাতার নামে করা লাইসেন্সের মাধ্যমে (এয়ারটেল বিডি লিমিটেড) ঠিকাদারি ব্যবসা করে বিপুল অর্থ আয় করছেন। বিধি অনুযায়ী বিআইডব্লিউটিএর কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী বা তাঁদের নিকটাত্মীয় সংস্থার কোনো লাভজনক কাজে যুক্ত হতে পারেন না। অভিযোগ আছে, আবুল হোসেন প্রভাব খাটিয়ে আপন ছোট ভাইকে চাকরি দিয়েছেন। চল্লিশোর্ধ্ব বয়সের মেহেদী হাসানকে অষ্টম শ্রেণি পাস দেখিয়ে চাকরি দেওয়ার বিষয়টি জানাজানি হলে তাড়াহুড়া করে জাতীয় পরিচয়পত্রে বয়স সংশোধন করা হয়। তবে মেহেদীর এসএসসি পাসের সনদে দেখা যায়, তাঁর বয়স চল্লিশের বেশি।
এ প্রসঙ্গে আবুল হোসেনও সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি কোনো অবৈধ সম্পদের মালিক নই।’
প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে দুদকে থাকা অভিযোগে আরও বলা হয়, তাঁদের অবৈধ আয়ের অন্যতম উৎস নিয়োগ-বদলি। তাঁদের অনৈতিক কাজের প্রতিবাদ করায় সংগঠনটির কয়েকজন নেতাকে শারীরিক নির্যাতন ও কর্তৃপক্ষকে চাপ দিয়ে ঢাকার বাইরে বদলি করার অভিযোগ আছে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম বিআইডব্লিউটিএ শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের যুগ্ম সম্পাদক সঞ্জীব দাশ, সাংস্কৃতিক সম্পাদক শহীদুল ইসলাম, দপ্তর সম্পাদক তুষার কান্তি বণিক, মুজিবর রহমান, মাযহার হোসেন প্রমুখ। তাঁদের মধ্যে তুষার কান্তি বণিককে বদলি করা হয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন ফেসবুকে শেয়ার করার অভিযোগে। সদরঘাটে অনিয়ম নিয়ে প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন ফেসবুকে শেয়ার করার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে ঢাকার বাইরে বদলি করে দেওয়া হয়।
এই দুই নেতার হাত থেকে বাঁচতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার অভিযোগ উঠলেও সেভাবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সম্প্রতি তাঁদের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগ অনুসন্ধানে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
বিআইডব্লিউটিএর দুই সিবিএ নেতাই বলেন, ‘যেসব অনুসন্ধান হচ্ছে, তা নিয়ে কোনো কথা বলতে চাই না। কিন্তু যাঁরা অভিযোগ করেছেন, তাঁরা বিএনপি-জামায়াতের লোক। সিবিএ থেকে আমাদের সরানোর চেষ্টায় মনগড়া অভিযোগ করা হয়েছে।’