‘ঘুমের মধ্যেও চিৎকার করে কেঁদে উঠছেন’ নরসিংদীতে পোশাক নিয়ে হেনস্তার শিকার তরুণী
নরসিংদী রেলস্টেশনে পোশাক নিয়ে মেয়েটি ও তাঁর বন্ধুদের হেনস্তা করার সময় একজন প্রবীণ নারী ভিক্ষুক ছাড়া আর কেউ প্রতিবাদ করেননি। গালিগালাজ করতে করতে চারজন নারী–পুরুষ মেয়েটির পোশাক ধরে টানছিলেন। আরেক ব্যক্তি মুখে প্রতিবাদ না করলেও মারমুখী ব্যক্তিদের একজনের হাত থেকে রড কেড়ে নিয়ে তাঁদের প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন। পাঁচ দিন ধরে ঘটনাটি নিয়ে তীব্র মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন ওই তরুণী। ঘুমের মধ্যেও চিৎকার করে কাঁদছেন। মা–বাবা এখনো জানেন না তাঁর সঙ্গে এমন অমানবিক একটি ঘটনা ঘটে গেছে। আজ রোববার প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ঘটনার কথা বিস্তারিত জানিয়েছেন ২২ বছরের মেয়েটি। তিনি রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী।
১৮ মে বুধবার ভোরে নরসিংদী রেলস্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষারত মেয়েটি জিনস ও টপস পরার কারণে গালিগালাজ ও মারধরের শিকার হন। এক ব্যক্তি অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে পুরো দৃশ্যটি ভিডিও করেন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করেন। ভিডিওটা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় ফেসবুকে। পোশাক পরা নিয়ে মারধরের ঘটনাকে চরম অসংবেদনশীল ও ন্যক্কারজনক উল্লেখ করে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সচেতন মানুষেরা। ভিডিওতে দেখা যায়, দুজন বোরকা পরা নারী, দুজন পুরুষ সবচেয়ে মারমুখী ছিলেন। তাঁরা গালিগালাজের সঙ্গে মেয়েটির পোশাক ধরে টানতে থাকেন এবং মারধর করেন। এর মধ্যে একজনকে গত শুক্রবার নরসিংদী গোয়েন্দা পুলিশ আটক করে ভৈরব রেলওয়ে থানায় হস্তান্তর করেছে। গতকাল শনিবার ভৈরব রেলওয়ে থানা–পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে ওই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে।
আক্রান্ত তরুণী জানিয়েছেন, তাঁরা বন্ধুরা অনলাইনে ফুড রিভিউ, ভ্লগিং নিয়মিত অনুসরণ করেন। নরসিংদীতে ‘স্ট্রিট ফুড’ (রাস্তায় তৈরি খাবার) খাওয়ার জন্য দুই বন্ধু ১৭ মে মঙ্গলবার ঢাকা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার ট্রেনে নরসিংদী যান। ওই বন্ধু তাঁর সবচেয়ে কাছের বন্ধু। তাঁদের প্রতিবেশী। তাঁর পরিবার ও ছেলেটির পরিবার পারিবারিকভাবে ঘনিষ্ঠ। তাঁরা একসঙ্গে বাস্কেট বল খেলতে যান, জিমে (ব্যায়ামের কেন্দ্র) যান। ঘটনার আগের দিন মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বাস্কেট বল খেলতে যাওয়ার কথা বলে দুই বন্ধু নরসিংদীতে যাওয়ার ট্রেনে ওঠেন। উদ্দেশ্য ছিল, খাবার খেয়ে রাতের ট্রেনে আবার ফিরে আসবেন। নরসিংদীতে তাঁদের সঙ্গী হন বয়সে বড় এক ছেলেবন্ধু। ওই বন্ধু নারায়ণগঞ্জে থাকেন। কয়েক দিনের জন্য নরসিংদীতে তাঁর গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন।
তরুণী বলেন, ‘নরসিংদীতে ভাইয়া আমাদের রিসিভ করেন। আমরা নরসিংদীর রাস্তার খাবার খেলাম, ছবি তুললাম। এরপর ভাইয়ার সঙ্গে তাঁর গ্রামের বাড়িতে গেলাম।
সেখানে ভাইয়ার পরিবার আমাদের খুব আপ্যায়ন করল। ওই পরিবারের সঙ্গেও আমাদের পারিবারিকভাবে মেলামেশা আছে। আমরা একে–অপরের বাসায় দাওয়াত খেয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভাইয়ার বোন আমাদের নিয়ে মেলায় গেলেন, নদীর পাড়ে ঘুরতে নিয়ে গেলেন। আমি ওই একই পোশাক পরা ছিলাম। কই সেখানে তো কেউ আমাকে কিছু বলেনি, স্টেশনে কেন ওই লোকজন আমার সঙ্গে এমন করলেন?’
এই বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষার্থী জানান, রাতে ঢাকায় ফিরতে চাইলে নরসিংদীর ওই বন্ধুর বোন আপত্তি করেন। নিরাপত্তার কথা বলে তিনি সকালে যেতে বলেন। রাতে ওই বাড়িতে তাঁরা থেকে যান। সবাই মিলে সিনেমা দেখে রাত পার করেন। সকাল সাড়ে নয়টায় বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর পরীক্ষা ছিল। তাই তাঁরা ভোরে ঢাকাগামী ট্রেন ধরতে স্টেশনে চলে আসেন।
রাতটা নরসিংদীতে থাকার বিষয়টি নিয়ে বাসায় কী বলেছিলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাবা ব্যবসার প্রয়োজনে দেশের বাইরে ছিলেন। মা অসুস্থ আত্মীয়কে দেখতে ঢাকার বাইরে ছিলেন। মাকে ফোন করে জানিয়েছিলেন তিনি প্রতিবেশী বন্ধুর বাসায় আছেন। বললেন, ‘আম্মুকে ভিডিও কলে দেখিয়েছিলাম যে আমরা ওর (প্রতিবেশী বন্ধু) বাসায় মুভি দেখছি।’
পরদিন বুধবার ভোর ৬টার ট্রেন ধরতে মেয়েটি ও তাঁর বন্ধুকে ভোর ৫টা ৪০ মিনিটে নরসিংদী রেলস্টেশনে পৌঁছে দেন নরসিংদীর বন্ধু। তিনি তখনই বিদায় নেন। এরপর সঙ্গে থাকা বন্ধু স্টেশনের ওয়াশরুমে যান। তরুণী বলেন, ‘আমি ওয়াশরুম ঘেঁষে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ওই সময় হঠাৎ এক নারী এসে মুঠোফোনে আমার ছবি তুলতে শুরু করেন এবং নোংরা ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকেন। এমন বাজে গালি আমি জীবনেও শুনিনি। আমি নিশ্চিত আপনিও (এই প্রতিবেদক) শোনেননি। এসব শব্দ আমি জীবনেও মুখে আনতে পারব না। ওই নারী বলছিলেন আমি জাহান্নামে যাব।
আমি প্রথমে খুব ভদ্রভাবে তাঁকে বলছিলাম, “আন্টি, আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন? আপনাকে দেখে তো ভদ্র মনে হয়।” ওই সময় আমার বন্ধু ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এসে এই অবস্থা দেখে ওই নারীকে বলে, “এটা একটা স্বাধীন দেশ। যে কেউ তার ইচ্ছেমতো পোশাক পরতে পারবে।” আমার গায়ে বড় ওড়না ছিল। শুধু পিঠ দেখা যাচ্ছিল। আমি ওই নারীকে এমনও বলেছি, “আমার গায়ে ওড়না আছে, সমস্যা হলে আপনি আমার পিঠ ঢেকে দিন।” কিন্তু ওই নারী কোনো কথা কানে তুলছিলেন না।’
পোশাক নিয়ে ওই নারীর সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডার কথা জানিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষার্থী বলেন, ‘ওই নারী আঙুল তুলে তুলে বলছিলেন, “তোর বাপ-মা কে? তোর বাপ-মা তোকে শাসন করে না?” আমি আর নিতে পারছিলাম না। প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল। বললাম, “আপনি জানেন আমার বাবা-মা শাসন করে না? আপনার মা–বাবাই আপনাকে শাসন করেননি। আপনিও আপনার ছেলেমেয়েকে শাসন করেননি।”’
মেয়েটি জানান, ওই পরিস্থিতিতে তিনি নরসিংদীর বন্ধুকে ফোন দেন। ততক্ষণে আরও এক বোরকা পরিহিত নারী ও দুজন পুরুষ ওই নারীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে গালিগালাজ করতে থাকেন তাঁকে। এক ব্যক্তি ভিডিও করছিলেন, তিনি সবচেয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করছিলেন। নরসিংদীর বন্ধু স্টেশনে এসে পরিস্থিতি দেখে বলেন, ‘চলো, তোমাদের বাসে তুলে দিই।’ ওই সময় আরেক নারী ও এক ব্যক্তি (যিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন) তাঁদের আটকে বলেন, ‘এখানে দাঁড়া। কোথাও যেতে পারবি না।’ ওই ব্যক্তি এরপর তাঁর প্রতিবেশী বন্ধুকে কলার ধরে টানতে থাকেন ও মারতে থাকেন। মেয়েটি বলেন, ‘একপর্যায়ে ওই চারজন আমার পোশাক ধরে টানতে থাকেন। মারতে থাকেন। আমার বন্ধু তাদের অনুরোধ করতে থাকে, “ওর ড্রেস ধরে টানছেন কেন? এত সমস্যা হলে ওড়না দিয়ে ঢেকে দিন!” এক ব্যক্তি ওই সময় রড নিয়ে মারতে আসেন। আমি দৌড়ে স্টেশনমাস্টারের কক্ষে ঢুকে যাই।’
এত লোক মিলে আক্রমণ করলেন, কেউ কি প্রতিবাদ করেছিলেন বা বাধা দিয়েছিলেন, জানতে চাইলে তরুণী বলেন, ‘একজন খুব বয়স্ক নারী ভিক্ষুক শুরু থেকেই প্রতিবাদ করছিলেন। আমি তাঁর কাছে সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকব। তিনি বারবার প্রথম নারীকে বাধা দিয়ে বলছিলেন, “ঢাকার মেয়েরা এমন পোশাকই পরে। তোমরা এমন করছ কেন?” তিনি আরও বলেছিলেন, “মামণি, তোমাকে এত লোকের সামনে অপমান করল, ওকে (প্রথম নারী) আরও বড় অপমানের মুখে পড়তে হবে। ওর সন্তানকে এমন অপমানের মুখে পড়তে হবে।” আর রড হাতে যে ব্যক্তি মারতে এসেছিলেন, তাঁর হাত থেকে রড কেড়ে নিয়ে এক লোক পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। বাকিরা কিছু বলেননি। পুলিশ এসে অনেক আন্তরিকতা দেখিয়েছে।’
পুলিশকে কখন জানিয়েছিলেন জানতে চাইলে তরুণী জানান, ঘটনার ৫ মিনিটের মধ্যেই তাঁর মুঠোফোন থেকে ৯৯৯ এ কল দেন তাঁর বন্ধু। এর ৫ মিনিট পর আবার ৯৯৯–এ কল দেওয়া হয়। ঘটনার ১০–১২ মিনিটের মধ্যে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছায়।
পুলিশ কর্মকর্তা উপস্থিত লোকজনকে ধমকাধমকি করেছিলেন। তিনি বলছিলেন, ‘মেয়েটার সঙ্গে আপনারা এমন করলেন কেন?’ পুলিশ পরে তাঁদের দুই বন্ধুকে ট্রেনে তুলে দেয়।
ঘটনার পর থেকে প্রচণ্ড রকম ভীতি ও বিষণ্নতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন ওই তরুণী। বললেন, ‘৪০ মিনিটের মধ্যে ঢাকায় পৌঁছাই। পুরো সময়টা আমি কেঁদেছি। বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে যাই। আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছিল। শিক্ষক ও বন্ধুরা বারবার জানতে চাইছিল কেন আমি কাঁদছি। একসময় খাতা রেখে ওয়াশরুমে গিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকি। এখনো আমি ঘুমের মধ্যেও চিৎকার করে কাঁদি। বাসার কেউ জানে না। আম্মুর কাছে কয়েকবার গেছি বলার জন্য। কিন্তু সাহস করে বলতে পারিনি।’
মানুষ দেখলেও ভয় লাগছে বলে জানান তরুণী। বললেন, ‘বন্ধুরা আমাকে সঙ্গ দিচ্ছে ভীতি কাটানোর জন্য। এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়ে একটি মেয়ে কীভাবে মানসিক শক্তি ধরে রেখেছিল, সেই মুভি দেখিয়েছে আমাকে। আমি আসলে কিছু ভুলতে পারছি না। খালি মনে হচ্ছে, আমার সঙ্গে কেন এমন হলো! নিজের ইচ্ছেমতো পোশাকও পরা যাবে না! এক এলাকার লোক অন্য এলাকায় গেলে তো ভালো ব্যবহার করার কথা। আমার সঙ্গে কেন তাঁরা এমন করল? আমার আসলে মানসিক স্থিতিশীলতার জন্য কাউন্সিলিংয়ে যেতে হবে।’
মামলা করবেন কি না জানতে চাইলে তিনি জানান, আরও হেনস্তার ভয়ে তিনি মামলা করার সাহস পাচ্ছেন না। তা ছাড়া পরিবারকে জানাননি কিছু, তাই এখনই মামলা করার মতো অবস্থায় নেই। ট্রলের ভয়ে নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাকাউন্ট বন্ধ রেখেছেন। তবে চান, রাষ্ট্র এই ঘটনায় অপরাধীদের শাস্তি দিক। যাতে কোনো মেয়েকে এভাবে ভবিষ্যতে হেনস্তায় পড়তে না হয়।
ভৈরব রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফেরদাউস আহমেদ বিশ্বাস প্রথম আলোকে জানান, পুলিশ বাদী হয়ে গতকাল শনিবার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ ও ৩০ ধারা এবং দণ্ডবিধির ১৪৩, ৩২৩ ও ৫০৬ ধারায় মামলা করেছে।
মামলার এজাহারে একজন পুরুষ ও একজন নারীর নাম আসামি হিসেবে দেওয়া হয়েছে এবং ৮–১০ জনকে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি হিসেবে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে এজাহারে নাম থাকা পুরুষকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। কাল সোমবার আদালতে রিমান্ডের ওপর শুনানি হবে। নারীকে গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
আইনের ধারাগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০–এর ১০ (যৌন নিপীড়ন ও ইত্যাদি) ধারায় ন্যূনতম শাস্তি ৩ বছর এবং সর্বোচ্চ ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের কথা লেখা আছে এবং ৩০ (অপরাধে প্ররোচনা ও সহায়তার শাস্তি) ধারায় সুনির্দিষ্ট কোনো দণ্ডের উল্লেখ নেই। দণ্ডবিধি ১৮৬০–এর ১৪৩ (জনগণের শান্তিপূর্ণ অবস্থার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ) ধারায় ৬ মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড, ৩২৩ (ইচ্ছাকৃতভাবে আঘাত করা) ধারায় এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং ৫০৬ (অপরাধমূলক ভীতি প্রদর্শন, অপমান, পক্ষপাতমূলক আচরণ ও বিরক্তি উদ্রেককারী) ধারায় ২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে।