মেয়েটির রক্তাক্ত দেহ পড়ে ছিল উড়ালসড়কের এক পাশে। কাছেই ক্ষতিগ্রস্ত স্কুটিটি। পথচারীদের কয়েকজন মেয়েটিকে নিয়ে গেলেন হাসপাতালে। অন্যরা জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯–এ ফোন দিলেন। তবে মাইশা নামের মেয়েটিকে বাঁচানো যায়নি।
মেয়ের শখ মেটাতে ছয় মাস আগে এই স্কুটি কিনে দিয়েছিলেন বাবা নূর মোহাম্মদ। মেয়ের মৃত্যুর পর বাবা বিলাপ করে শুধুই বলছিলেন, ‘কেন স্কুটি কিনে দিলাম।’
রাজধানীর খিলক্ষেতে উড়ালসড়কে গতকাল শুক্রবার সকাল সাড়ে সাতটার দিকে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাইশা মমতাজ মীম। তিনি ইংরেজি বিভাগের ষষ্ঠ সেমিস্টারের শিক্ষার্থী ছিলেন। ছুটির দিনে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে উত্তরার বাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যাচ্ছিলেন। খিলক্ষেত উড়ালসড়ক দিয়ে ৩০০ ফুট যাওয়ার পথের ঢালে তিনি দুর্ঘটনার শিকার হন।
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির তথ্যমতে, ২০১৪ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত আট বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় যত মানুষ মারা গেছেন, এর মধ্যে ১১ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ ছিলেন শিক্ষার্থী। এ সময় প্রতিবছরই গড়ে ৮০০ করে শিক্ষার্থী সড়কে প্রাণ হারিয়েছেন।
পুলিশের খিলক্ষেত থানার ওসি মুন্সি সাব্বির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, দুর্ঘটনার কোনো প্রত্যক্ষদর্শীকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে দুর্ঘটনাস্থলের কাছাকাছি একটি জায়গার সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে, একটি কাভার্ড ভ্যান মাইশার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে।
পুলিশের ক্যান্টনমেন্ট জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার ইফতেখায়রুল ইসলাম গতকাল রাত ১১টায় প্রথম আলোকে বলেন, কিছুক্ষণ আগে চট্টগ্রাম থেকে গাড়ির চালক সাইফুল ইসলাম (৪৪) ও তাঁর সঙ্গে থাকা মশিউরকে আটক করা হয়েছে। সাইফুলের হালকা যান চালানোর লাইসেন্স ছিল। কিন্তু তিনি চালাচ্ছিলেন ভারী গাড়ি। তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। মশিউর হলেন গাড়িতে থাকা মালামালের মালিকপক্ষের প্রতিনিধি।
পুলিশ জানায়, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে চালক জানিয়েছেন, স্কুটির পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় তিনি হর্ন দেন। এতে স্কুটিচালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তাঁর গাড়ির সামনের চাকার নিচে পড়েন। এরপর তিনি পালিয়ে যান।
পড়াশোনার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচারে পরামর্শদাতা একটি প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন কাজ করতেন মাইশা। প্রায় ৯ মাস ধরে তিনি সেখানে কাজ করছিলেন। লেখাপড়ার ক্ষতি হওয়ায় অতিসম্প্রতি কাজটি তিনি ছেড়ে দেন।
পুলিশ জানায়, ঘটনার পর পথচারীরা মাইশাকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান। কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে পরীক্ষা করে মৃত ঘোষণা করেন। ময়নাতদন্তের জন্য লাশ পাঠানো হয় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পরে পরিবারের পক্ষে লাশ গ্রহণ করেন মাইশার মামা, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোখলেসুর রহমান।
মাইশার শিক্ষকের কথা
মাইশার মৃত্যুর পর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক শর্মি হোসেন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আজ আমাদের বিভাগে একটা ইভেন্টে আসার জন্য মেয়েটা রওনা হয়েছিল। দুই বছর অনলাইনে ক্লাস করা বাচ্চা মেয়েটা হয়তো অনুষ্ঠানটিতে খুব আনন্দ নিয়ে যুক্ত হয়েছিল—কিছু কাজ শিখবে, প্রিয় বন্ধুদের সঙ্গে একটু আড্ডা দেবে, রাতে কিছু ছবি পোস্ট করবে। এই–ই তো। শেষ হয়ে গেল সব।’
শর্মি হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন স্কুল–কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে ক্যাম্পাসে ভাষা প্রতিযোগিতা চলছে। ওই প্রতিযোগিতায় মাইশা আয়োজকদের পক্ষে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছিলেন। অনুষ্ঠানে যোগ দিতেই মাইশা ক্যাম্পাসে যাচ্ছিলেন।
মাইশার মামাতো ভাই নকীব আলী জানান, মাইশার বাবা নূর মোহাম্মদ গাজীপুরের কালিয়াকৈরে নিজের প্রতিষ্ঠা করা মৌচাক আইডিয়াল পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ। তাঁর দুই মেয়ের মধ্যে মাইশা বড়। ছোট মেয়ে রৌদোসী মমতাজ মৌ রাজউক কলেজ থেকে এবার এইচএসসি পাস করেছেন। দুই মেয়ের লেখাপড়ার সুবিধার্থে তিন বছর আগে নূর মোহাম্মদ উত্তরার ৬ নম্বর সেক্টরে বসবাস শুরু করেন। কালিয়াকৈরে তাঁদের বাড়ি রয়েছে।
মা জানলেন বিকেলে
মাইশার ছোট বোন রৌদোসী মমতাজ মৌয়ের মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা ছিল গতকাল সকাল ১০টায়। রৌদোসীকে নিয়ে সকালেই মা অছিমা বেগম মিরপুর বাঙলা কলেজে চলে যান। তখনো তিনি জানেন না মাইশা দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। বাসায় ফিরলে অছিমা বেগমকে স্বজনেরা জানান, মাইশা দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে আছেন। তখন তিনি হাসপাতালে যেতে চান। স্বজনেরা নানা কথা বলে তাঁকে বিরত রাখার চেষ্টা করেন।
মাইশার নিকটাত্মীয় নকীব আলী বলেন, বিকেলে মাইশার লাশ কালিয়াকৈরের মৌচাকে পাঠানোর পর মা ও ছোট বোনকে নিয়ে স্বজনেরা সেখানে রওনা দেন। তাঁদের গাড়ি যখন হাসপাতালে না গিয়ে গাজীপুরের দিকে যাচ্ছিল, তখনই মাইশার মা বুঝে যান মেয়ে আর বেঁচে নেই। এর আগে সকালে দুর্ঘটনার খবর পেয়ে মাইশার বাবা নূর মোহাম্মদ সংজ্ঞা হারান। তাঁকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। একটু সুস্থ হলে বিকেলে স্বজনেরা তাঁকে নিয়ে কালিয়াকৈরে যান।
এদিকে মাইশার লাশ কালিয়াকৈরের মৌচাকে পৌঁছালে তাঁর শিক্ষক, সহপাঠী, আত্মীয়স্বজন এবং এলাকাবাসী ছুটে আসেন। মা–বাবা ও স্বজনেরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। মা সংজ্ঞা হারালে আত্মীয়স্বজন তাঁকে বিছানায় শুইয়ে দেন। আর বাবা বিলাপ করে বলছিলেন, স্কুটি কিনে না দিলে মেয়ের এই পরিণতি হতো না। বারবার তিনি নিজেকে দোষারোপ করছিলেন।
এশার নামাজের পর রাত সাড়ে আটটায় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে মাইশাকে দাফন করা হয়।
মৃত্যু বেড়েছে ২৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) তথ্য বলছে, গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৫ হাজার ৮৮ জনের। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৩ হাজার ৯১৮ জন। এক বছরের ব্যবধানে মৃত্যু বেড়েছে ২৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ। পুলিশের হিসাবে, ২০১৮ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২ হাজার ৬৩৫ জন। আর ২০১৯ সালে দুর্ঘটনায় ৪ হাজার ১৩৮ জনের মৃত্যু হয়।
অবশ্য পুলিশের হিসাবের সঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠনগুলোর তথ্যের বেশ পার্থক্য রয়েছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৬ হাজার ২৮৪ জন। ২০২০ সালে মারা যান ৫ হাজার ৪৩১ জন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কয়েক বছর পরপর সড়ক দুর্ঘটনার প্রাণহানির প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ২০১৮ সালের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর প্রাণহানি হয় ২৫ হাজার মানুষের।