গ্রেনেড হাতে এক গেরিলা যোদ্ধা
৬৩ বছরের আলীজান বলছিলেন নিজের কথা, ঢাকার যাত্রাবাড়ীর এক খাবারের দোকানে বসে, ১০ ডিসেম্বর শনিবার সকাল ৯টায়। গায়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের একটি মলিন টি-শার্ট। রোদে পোড়া তামাটে চেহারা। তবে ঋজু তাঁর কণ্ঠ।
আলীজানের বাবা আরজু মিয়া ছিলেন ব্রিটিশ নৌবাহিনীর সদস্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ করেছেন রেঙ্গুন আর সিঙ্গাপুরে। আলীজান ১৯৭১-এ সদরঘাট নৌ টার্মিনালে কুলির সরদারি করতেন।
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রাজারবাগ ও পিলখানা আক্রমণ করলে শত শত পুলিশ আর ইপিআর সদস্য সাঁতরে নদী পার হয়ে কেরানীগঞ্জে আশ্রয় নেন।
আলীজান স্মরণ করেন, ‘২৬ মার্চ সকালবেলা মন্টু ভাই, খসরু ভাই (তখনকার ছাত্রনেতা মোস্তফা মহসীন মন্টু ও আমীর খসরু) আসলেন। তাঁরা কেরানীগঞ্জ থানা ও আগানগর কেচি সাহা এলাকার আনসার ক্যাম্প থেকে অস্ত্র নিয়েছিলেন। পুলিশ ও আনসার সদস্যরা তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন। মোস্তফা মহসীনের বাড়ির সামনে নেকরোজবাগ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ হতো। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সারা রাত বুড়িগঙ্গায় টহল দিত।’
মুক্তিযুদ্ধকালীন ঢাকা মহানগর ও জেলা কমান্ডার মোস্তফা মহসীন মন্টুর সঙ্গে কথা হলো মুঠোফোনে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, আলীজান কেরানীগঞ্জের বাঘৈর ক্যাম্পে যুদ্ধ করেছেন। ছিলেন অসম্ভব সাহসী এক মুক্তিযোদ্ধা।
মুক্তিযুদ্ধকালে ঢাকার এই অঞ্চল ছিল ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে। কেরানীগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ক্যাম্পের কমান্ডার ছিলেন নুরুল ইসলাম। এই ক্যাম্পের গেরিলা যোদ্ধা ছিলেন আলীজান।
২ এপ্রিল ভোরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কেরানীগঞ্জ আক্রমণ করে। মনু ব্যাপারীর ঢালের ওপরই ওরা ৪০০-৫০০ মানুষ মেরে ফেলে রাখে। পুরো অভিযানে ৫ হাজার নিরপরাধ লোককে হত্যা করে। আলীজান বলেন, অস্ত্রের অভাবে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ করতে পারেননি। পিছু হটেন। অনেকে চলে যান ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে। আলীজান যেতে পারেননি।
নুরুল ইসলাম ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে কেরানীগঞ্জের রাজেন্দ্রপুরের বাঘৈরে ক্যাম্প করেন। আলীজান তাঁর কাছে নেন গেরিলা প্রশিক্ষণ।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পেরিয়ে যুদ্ধ যখন তুমুল আকার নিয়েছে, মুক্তিযোদ্ধারা একদিন সিদ্ধান্ত নেন জিঞ্জিরা পিএম পাইলট হাইস্কুলে রাজাকারদের ক্যাম্প আক্রমণ করার।
নুরুল ইসলাম কমান্ডারের নেতৃত্বে শেষ রাতে প্রচণ্ড আক্রমণ করেন মুক্তিযোদ্ধারা। একটা মাইন পাতা হয় রাজাকার ক্যাম্পের দেয়ালে। কিন্তু মাইনটি বিস্ফোরিত হয়নি। উপায় না দেখে মুক্তিযোদ্ধারা গুলিবর্ষণ করেন। আলীজান বলেন, ‘আমার হাতে ছিল গ্রেনেড। আমি কমান্ডারকে কভার দিই। আমরা গুলি করি, গ্রেনেড ছুড়ি। কিন্তু ওদের দিক থেকে কোনো গুলি আসছিল না। পরে জানতে পারি ওরা আগেই সটকে পড়েছিল।’
রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণের প্রতিশোধ নিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আবার কেরানীগঞ্জে অভিযান চালায়। রাজাকারদের সহায়তায় ঘরে ঘরে গিয়ে অসংখ্য তরুণকে হত্যা করে ফেলে দেয় বুড়িগঙ্গায়।
এরপর আরেকটি অভিযানে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের টাওয়ার উড়িয়ে দেন আলীজান। এ ছাড়া আরও কয়েকটি অভিযানে অংশ নেন।
১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের কথা স্মরণ করতে পারেন আলীজান। সাইকেল চালিয়ে বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন। দেয়ালে গুলির ক্ষতচিহ্ন। হাজার হাজার ঢাকাবাসী। ভারতীয় সেনাদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন। আরেক দিকে যুদ্ধবন্দী পাকিস্তানি সেনারা। তাদের পরাজিত মাথা নিচু।
আলীজান এখন
মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই অস্ত্র জমা দিয়ে আলীজান পেয়েছিলেন এম এ জি ওসমানী ও মেজর হায়দারের স্বাক্ষর করা একটি সনদ, যেটি ছিল দেশরক্ষা বিভাগ থেকে দেওয়া ‘স্বাধীনতা সংগ্রামের সনদপত্র’।
দেশ স্বাধীনের পর মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে বেকার হয়ে পড়েন। বঙ্গবন্ধু গঠিত রক্ষীবাহিনীতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল, কিন্তু যাননি। তাঁর বাবা দুটি নৌকা কিনে দেন। একটি ভাড়া দেন, আরেকটি নিজে চালাতেন।
১৯৭৫ সালের দিকে আগানগরে ‘নিউ গুলশান’ নামের সেই সিনেমা হলে টিকিট কালেক্টরের চাকরি নেন আলীজান। বেতন ৭০০ টাকা। এখনো এই চাকরিই করছেন তিনি। বেতন বেড়ে হয়েছে চার হাজার টাকা। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাওয়া শুরু করেন ২০০৭ সাল থেকে।
পৈতৃক সূত্রে পাওয়া পৌনে ১ শতাংশ জমিই তাঁর সম্বল। তিনটি কক্ষ বানিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিয়েছেন ছেলেকে।
কিছুটা হতাশ কণ্ঠে আলীজানের উচ্চারণ, ‘দেশ স্বাধীন করলাম, কী হইল। দেশ তো লুটেপুটে খেয়ে গেল।’
গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা আলীজানকে আর ধরে রাখা গেল না। ১২টা বাজতে চলল। সিনেমার শো শুরু হবে। ডিউটি আছে তো!