গৃহকর্মী নির্যাতন বন্ধে আইন হচ্ছে
শিশু গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করতে আইন প্রণয়নের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক চুন্নু। আজ বুধবার কারওয়ান বাজারে দৈনিক প্রথম আলো কার্যালয়ে এক গোলটেবিল আলোচনায় তিনি এ কথা জানান। আইন প্রণয়নের পাশাপাশি সবাইকে মানবিক হওয়ারও আহ্বান জানান মন্ত্রী।
মুজিবুল হক বলেন, গৃহকর্মীর ওপর নির্যাতন নতুন নয়। অনেকেই তাদের মানুষ বলে মনে করেন না। তারা কারও কাছ থেকেই সহানুভূতি পায় না। উচ্চশিক্ষিত ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরাই গৃহকর্মীদের ওপর বেশি নির্যাতন করেন বলে জানান তিনি। এ ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। গৃহকর্মী নির্যাতন প্রতিরোধে নীতিমালা করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এই নীতিমালাকে আইনে পরিণত করার কাজ চলছে।
‘আসুন শিশু গৃহকর্মীদের প্রতি মানবিক হই’ শিরোনামে এই গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করে দৈনিক প্রথম আলো। বিভিন্ন সময়ে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে প্রথম আলোর অগ্রণী ভূমিকার কথা তুলে ধরেন পত্রিকাটির সম্পাদক মতিউর রহমান। তিনি বলেন, অ্যাসিড-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জাগরণ, নারী ও শিশু নির্যাতনবিরোধী আন্দোলন, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তার পাশাপাশি নানা কল্যাণমুখী কাজে প্রথম আলো সব সময় এগিয়ে এসেছে। চাঁদপুরের নির্যাতিত গৃহকর্মী শিশু জান্নাতের পাশেও দাঁড়িয়েছে প্রথম আলো। মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য কাজ করে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ন্যাশনাল প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর সৈয়দা মুনীরা সুলতানা বলেন, আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী, কোনো শ্রমিক আট ঘণ্টার বেশি কাজ করতে পারেন না। কিন্তু গৃহশ্রমিকেরা ১৪ থেকে ১৬ ঘণ্টা, কখনো তার বেশিও কাজ করেন। তিনি বলেন, গৃহকর্মী নির্যাতন প্রতিরোধে যে নীতিমালা করা হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে ১৪ বছরের কম বয়সী কোনো শিশু গৃহকর্মী হতে পারবে না। তবে ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সীরা হালকা ধরনের কাজ করতে পারবে। এই ‘হালকা ধরনের কাজ’-এর কোনো সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়নি। গৃহকর্মী নির্যাতন ঠেকাতে আইনটা করা খুবই জরুরি বলে জানান তিনি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার (ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার) ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে যেসব অভিযোগ আসে, তার ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশই গৃহকর্মী। অনেক সময় সঠিক তথ্যের অভাবে তাদের সেবা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যার যার মতো করে জরিপ করে। তাই গৃহকর্মীদের বিষয়ে সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। এ সমস্যা দূর করতে সবার মধ্যে সমন্বয় করে কাজ করা উচিত বলে জানান তিনি। সেই সঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ধার অভিযান চালাতে দেশের ৬৪টি জেলায় ৬৪টি ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার করার পরামর্শ তাঁর।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বলেন, অনেক সময় গৃহকর্মী নির্যাতনের মামলা করা হলেও একপর্যায়ে অভিভাবকেরা টাকার বিনিময়ে আপস করে নেন। এতে করে নির্যাতনকারী ছাড়া পেয়ে যান। অভিভাবকদের আরও সচেতন হওয়ার পাশাপাশি এই মামলাগুলো দ্রুত সময়ে শেষ করার দাবি জানান তিনি।
নিবন্ধন ছাড়া গৃহকর্মী না রাখার পরামর্শ দেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমদ। সেই সঙ্গে প্রতি মাসে নিয়মিত পরিদর্শন করা জরুরি বলেও জানান তিনি। শিশু গৃহকর্মী নিয়োগ বন্ধ করতে করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার আওতায় গ্রামভিত্তিক কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পরামর্শ দেন তিনি।
সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আজিজ খান বলেন, শিশু জান্নাতের ওপর যে নির্যাতন করা হয়েছে, তা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। এ ধরনের অপরাধ রুখে দিতে গৃহকর্মীদের শ্রম আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।
আলোচনায় গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ক্রমাগত মানুষের মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে। অন্যকে দায়ী না করে নিজের ভাবনার জায়গাটা পরিবর্তন করতে হবে। গৃহকর্মীদের অধিকার শুধু মানবতায় নয়, মানবাধিকারেরও বিষয়। গণমাধ্যমে ‘হট লাইন’ হিসেবে একটি নম্বর প্রকাশ করার কথা বলেন তিনি, যেখানে নির্যাতিত যে কেউ ফোন করে তথ্য জানাতে পারবে। আর এ কাজে সবার আগে প্রথম আলোকেই এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
বৈঠকে চাঁদপুরের নির্যাতিত গৃহকর্মী শিশু জান্নাতের মা ফিরোজা বেগম তাঁর মেয়েকে নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেন। বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।