কুষ্টিয়ায় জাতীয় শোক দিবসের র্যালির পর দুই পক্ষের সংঘর্ষে আওয়ামী লীগের কর্মী সবুজ নিহতের ঘটনায় থানায় হত্যা মামলা হয়েছে। গতকাল রোববার দুপুরে সবুজের মেজো ভাই আরিফ হোসেন বাদী হয়ে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ সাজ্জাদ হোসেন ওরফে সবুজকে এক নম্বর আসামি করে ২০ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন।
এদিকে সংঘর্ষের সময় কর্তব্যে অবহেলার দায়ে কুষ্টিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল খালেককে প্রত্যাহার করে খুলনা রেঞ্জে সংযুক্ত করা হয়েছে। ঘটনার দিন গুলি ছোড়া যুবককেও পুলিশ শনাক্ত করতে পেরেছে। তিনি পুলিশের চাকরিচ্যুত এএসআই আনিচুর রহমান ওরফে আনিচ। পুলিশের ভাষ্য, তাঁকে আটকের জন্য একাধিক দল মাঠে কাজ করছে।
শোক দিবসে জেলা আওয়ামী লীগের র্যালি শেষে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সঙ্গে শহর আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক মোমিনুর রহমানের সমর্থকদের সংঘর্ষ হয়। এতে ছুরিকাঘাতে আওয়ামী লীগের সমর্থক সবুজ হোসেন (২৪) নিহত হন।
থানায় হত্যা মামলা: বেলা সাড়ে তিনটার দিকে নিহত সবুজের মেজো ভাই আরিফ হোসেন বাদী হয়ে ২০ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও দু-তিনজনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় শেখ সাজ্জাদ হোসেন সবুজকে এক নম্বর আসামি করা হয়।
সবুজের ভাই আরিফ হোসেন মডেল থানার ভেতরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আওয়ামী লীগকে ভালোবেসে র্যালিতে গিয়েছিলাম। চোখের সামনে ভাইকে মেরে ফেলা হয়েছে। থানায় হত্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। এখন বিষয়টি প্রশাসন দেখবে।’
মডেল থানার সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) খন্দকার লাবনী বলেন, সবুজকে হত্যার অভিযোগে মামলাটি জেলা গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত করবে।
ওসি প্রত্যাহার: কুষ্টিয়া মডেল থানার ওসি আবদুল খালেককে প্রত্যাহার করে খুলনা রেঞ্জে সংযুক্ত করা হয়েছে। গোয়েন্দা শাখার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে দুপুরে প্রথম আলোকে এ কথা বলেন। শনিবার সংঘটিত ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য এবং ভিডিও ফুটেজ থেকে দেখা গেছে, সংঘর্ষের সময় ঘটনাস্থলের ৩০-৩৫ ফুট দূরেই অবস্থান করছিলেন ওসি আবদুল খালেকসহ পুলিশের একটি দল।
গুলি ছোড়া যুবক সাবেক এএসআই: ভিডিও ফুটেজে যে ব্যক্তিকে সংঘর্ষের সময় শটগানের গুলি ছুড়তে দেখা গেছে, তাঁর নাম আনিচুর রহমান ওরফে আনিচ। সদর উপজেলার ঢাকা ঝালুপাড়া গ্রামের মোশাররফ হোসেন মণ্ডলের ছেলে আনিচ ছিলেন পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই)। প্রায় দেড় বছর আগে ঢাকার পল্লবী থানায় থাকার সময় ফেনসিডিল আত্মসাতের দায়ে তাঁর চাকরি যায়। তখন থেকে তিনি গ্রামেই থাকতেন। জেলা গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা ও গ্রামটির দুজন বাসিন্দা প্রথম আলোকে বন্দুকধারীর পরিচয় নিশ্চিত করেছেন।
কুষ্টিয়া পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আনিচ এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন। শটগানটি ছিল মোমিনুরের। অস্ত্রটি উদ্ধারে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, মোমিনুর ছাড়াও জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ কয়েকজনের অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিলের প্রক্রিয়া চলছে।
অস্ত্র-গুলি জব্দ: কুষ্টিয়া মডেল থানার ওসি আবদুল খালেক বলেন, শনিবার রাতে অভিযান চালিয়ে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ সাজ্জাদ হোসেন সবুজের লাইসেন্স করা শটগান, শটগানের ৪৬টি গুলি ও লাইসেন্স করা পিস্তলের ৬৪টি গুলি জব্দ করা হয়েছে। তবে পিস্তল পাওয়া যায়নি। অভিযানের সময় সাজ্জাদ বাড়িতে ছিলেন না।
সংঘর্ষের নেপথ্যে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা: কয়েকজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগের নেতা এই প্রতিবেদককে বলেন, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে মোমিনুর রহমানের উত্থান ঘটতে থাকে। চরমপন্থীদের সহযোগিতায় জেলার বড় বড় ঠিকাদারি কাজ তাঁর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। কুষ্টিয়া সদর উপজেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা মোমিনুর ২০১৩ সালে শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ পান।
কয়েকটি সূত্র বলছে, শহরের নিয়ন্ত্রণ, ঠিকাদারি কাজ ও কোর্টপাড়ার দখল করা একটি বাড়ি থেকে মোমিনুরকে উচ্ছেদ করা নিয়ে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ সাজ্জাদ হোসেন সবুজের সঙ্গে তাঁর বিরোধ শুরু হয়। একাধিকবার দুই নেতার সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষও হয়। বছর খানেক আগে মোমিনুরকে শহর থেকে বিতাড়িত করে পুরো নিয়ন্ত্রণ নেন সাজ্জাদ। কোর্টপাড়ার দখল করা বাড়িটি থেকে সাজ্জাদের লোকজন মোমিনুরকে উচ্ছেদ করে। এসব নিয়ে বিরোধ প্রকট হয়ে ওঠে।
সর্বশেষ ২০১৪ সালের ১৪ এপ্রিল মিরপুর উপজেলায় জাসদ নেতা ও পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী ইসমাইল হোসেন পাঞ্জের হত্যা মামলায় সাজ্জাদকে আসামি করা হয়। সাজ্জাদের ধারণা, মোমিনুরের ইন্ধনেই তাঁকে আসামি করা হয়েছিল। তবে চূড়ান্ত অভিযোগপত্র থেকে পুলিশ সাজ্জাদকে বাদ দেয়।
অন্যদিকে ২০১৪ সালের আগস্টে মোমিনুরের নামে পর্নোগ্রাফি আইনে একটি মামলা হলে তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক এক নেতা জানান, মোমিনুর দল থেকে বহিষ্কার ও পর্নোগ্রাফি মামলায় আসামি হওয়ার পর শহর ছেড়ে নিজের গ্রাম ঢাকা ঝালুপাড়ায় চলে যান। শহরে তাঁর অবস্থান নাজুক হয়ে পড়ে। এই প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার পর্নোগ্রাফি মামলায় আদালত থেকে বেকসুর খালাস পান তিনি। খালাস পেয়েই শহরে আধিপত্য বিস্তারে তৎপর হন। শোক দিবসের দিন তিন-চার শ সমর্থক নিয়ে মজমপুর গেটে অবস্থান নেন তিনি। একপর্যায়ে মিছিল নিয়ে শহরে প্রবেশ করেন। আর এতে সাজ্জাদসহ ছাত্রলীগের একটি অংশ উত্তেজিত হয়ে মোমিনুরের সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতেই নিহত হন সবুজ হোসেন।
জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক ওই নেতা বলেন, মোমিনুরের এই প্রত্যাবর্তনের পেছনে জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতার হাত আছে। ওই নেতার সঙ্গে রয়েছে সাজ্জাদ হোসেনের বিরোধ। এ ছাড়া, সাজ্জাদ আসন্ন পৌর নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেওয়ায় দলের জ্যেষ্ঠ কয়েকজন নেতা তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী এ ব্যাপারে বলেন, ‘শোক দিবসের র্যালিতে যে কেউ আসতে পারে। তবে সেখানে অস্ত্র আসবে কেন? মোমিনুর দলের বহিষ্কৃত নেতা। হঠাৎ করে দলবল নিয়ে তাঁর মহড়ার বিষয়টি নিয়ে সবাই প্রশ্ন তুলেছে।’