গান ও ইভ টিজিং
সংস্কৃতি ও বিনোদনের ক্ষেত্রে মানুষের মনে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী অঙ্গনটি হলো সংগীত বা গান। সব শ্রেণি–পেশার মানুষ এবং গানের বিভিন্ন শ্রেণিবিন্যাস বিবেচনায় শতভাগ মানুষেই গান পছন্দ করে। কেউ রবীন্দ্রসংগীত, কেউবা নজরুলসংগীত, কেউ লালনগীতি, কেউবা ফোক, কেউ প্রার্থনাসংগীত, কেউবা ইসলামি সংগীত ইত্যাদি ইত্যাদি।
অর্থাৎ যেকোনো মানুষ কোনো না কোনো ধরনের গান পছন্দ করেই। গান অপছন্দ করে—এমন কেউ এই পৃথিবীতে নেই! গানের ব্যাপ্তি যেমন বেশি, মানুষের ওপর এর প্রভাবও বেশি। সচেতন বা অবচেতন মনে মানুষ গানের কথাগুলো হৃদয়ে স্থান দেয়। তাই গানের কথা বেশ গুরুত্বপূর্ণ সবার জন্য। তবে এ আলোচনায় তরুণ প্রজন্মকে ইভ টিজিংয়ে উদ্যত করতে কিছু গান কীভাবে প্রভাব ফেলে, তা একটু ভেবে দেখা যাক।
যদি আমরা আমাদের অনুজ প্রজন্মকে, আমাদের সন্তানকে গানে গানে ইভ টিজিং করা শিখিয়ে দিই এবং আবার বলব, তোমরা ইভ টিজিং কোরো না! এমন চাওয়া সম্ভবত অবাস্তব, ফলাফল হতাশাব্যঞ্জকই স্বাভাবিক। উদাহরণস্বরূপ, জনপ্রিয় একটি গান আছে, ‘মেলায় যাইরে’। গানের এমন কথা আছে ‘বখাটে ছেলের ভিড়ে ললনাদের রেহাই নাই।’ কমবেশি যেকোনো মেলায় গেলে গানটি উচ্চ স্বরে বাজতে শোনা যাবে। কোনো মেলায় গিয়ে নেহাত কোনো ভদ্র ছেলে এ গান শুনলে তারও একটু সুযোগে বখাটে হওয়ার ইচ্ছা জাগতে পারে। আর বখাটেরা তো সাধ্যমতো চেষ্টা করবে অপরকে হেনস্তা করার। কারণ, তাদের তো এভাবেই মেলা উপভোগ করতে বলা হচ্ছে! আবার একটি গান আছে, ‘...পরা মেয়ে আমায় পাগল করেছে’ কিংবা ‘চুমকি চলেছে একা পথে, সঙ্গী হলে দোষ কী তাতে?’—এসব গান শুনে কোনো কিশোর বা যুবক কোনো বোরকা পরা মেয়ে দেখে বা কোনো একলা মেয়ে পেয়ে এ গানগুলোই গেয়ে ওঠে, তাহলে ওই তরুণ বা যুবককে আপনি বা আমি টিজার বলতে পারি কি? সে তো যুক্তি দেখাতে পারে, সে কেবল গান গেয়েছিল মাত্র!
দুটি উদাহরণ দিলাম, দুটিই গান। বলতে পারেন ইভ টিজিং তো আরও নানাবিধ উপায় করা হতে পরে, তবে উদাহরণ কেন শুধু গানের? কারণ, প্রথমত, টিজাররা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গানই ব্যবহার করে। অশ্লীল কবিতা, গল্প এবং উক্তিও অবশ্য তাদের শেখানো হয় ঠিকই, তবে তার ব্যবহার ওরা একটু কমই করে। দ্বিতীয়ত, আগেই বলেছি, গানের আবেদন তরুণদের ওপর বেশ প্রবল। খেয়াল করলে দেখবেন, একজন অশিক্ষিত মানুষও একটি কঠিন গান মুখস্থ করে ফেলতে পারেন, কিন্তু সেই একই কথা তিনি সচরাচর বলতে পারেন না! শুধু তা–ই নয়, অন্যান্য বিষয়ের চেয়ে গানই তরুণেরা বেশি সময় ধরে মনে রাখেন এবং চর্চা করেন। এমনকি খুঁজে খুঁজে তাঁরা টিজার গানগুলো বের করেন। তাই গানের কথা তরুণদের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ এবং গভীর ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে। এসব কারণেই গানের ভাষা পরিশীলিত এবং মার্জিত হওয়া উচিত।
সুতরাং, গানে অশ্লীলতা তরুণ ও যুবসমাজের জন্য ভয়ংকর হতে পারে। সমাজের খারাপ মানুষদের উসকে দিতে পারে, বাড়াতে পারে ইভ টিজিং ও কিশোর অপরাধ। কোনো শিল্পীর গাওয়া গান বা কোনো গীতিকারের লেখা গান ইভ টিজারদের মুখে মুখে থাকুক, এটা কোনো গায়ক বা গীতিকারের নিশ্চয়ই কাম্য হতে পারে না। তাই গান গাওয়া, লেখা এবং বাজারজাতকরণের দিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত, যাতে এসব গান কোনো তরুণ-তরুণী বা যুবক-যুবতী, সর্বোপরি মানুষ এবং সমাজের জন্য অকল্যাণকর বা ক্ষতির কারণ না হয়। এখানেই উপসংহার টানতে চেয়েছিলাম, কিন্তু হঠাৎ মনে হলো, বিষয়টি একান্ত ব্যক্তিগত বলে এই লেখা কারও কারও কাছে গুরুত্বহীন বলে মনে হতে পারে। আসলে কিন্তু তা নয়, আমাদের মনে রাখতে হবে, এই সমাজ কিন্তু আপনার বা আমার ‘ব্যক্তিগত’ কর্মকাণ্ডেরই সমন্বিত রূপ। সুতরাং, মানুষের জন্য সুস্থ বিনোদন ও মানসিক শান্তির মাধ্যম হয়ে থাকুক গানের জগৎ।
লেখক: ব্যাংকার