গল্পের ফাঁদ, অভিনব প্রতারণা
র্যাব বলছে, সাধারণ মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে লেখা কথিত চিঠির পাশাপাশি নিজেকে লেখা চিঠি দেখাতেন সাইফুল ইসলাম। আসলে এসব চিঠি তিনি নিজেই তৈরি করতেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ, মালদ্বীপসহ বিশ্বের অনেক দেশ পানির নিচে তলিয়ে যেতে পারে। এই দুর্যোগ থেকে এসব দেশকে রক্ষা করতে একটি ফর্মুলা তৈরির পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ উন্নত বিশ্বের অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে চিঠি লিখেছেন রাজা বাদশা গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম। এসব চিঠির জবাব দিয়ে জলবায়ু প্রকল্পে বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন বিশ্বনেতারা। এমনকি ইরাকের এক আইনজীবী তিন ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। এসব টাকা দেশে আনতে জটিলতা তৈরি হওয়ার কিছু জায়গায় অনাকাঙ্ক্ষিত খরচ হচ্ছে। তাই এখন এই প্রকল্পে কেউ ২৫ হাজার টাকা বিনিয়োগ করলে এক কোটি টাকা ফেরত পাবে।
এমন অভিনব গল্প ফেঁদে ১০ বছর ধরে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি চক্রের বিরুদ্ধে। গত চার মাসে শতাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে প্রায় ১০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে তথ্য পেয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
র্যাব বলছে, সাধারণ মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে লেখা কথিত চিঠির পাশাপাশি নিজেকে লেখা চিঠি দেখাতেন সাইফুল ইসলাম। আসলে এসব চিঠি তিনি নিজেই তৈরি করতেন। এমনকি দেশের কল্যাণে রাজা বাদশা গ্রুপের পক্ষ থেকে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ২০০ কোটি টাকা প্রদান করবেন বলেও সাধারণ মানুষকে গল্প বলতেন। প্রধানমন্ত্রীকে লেখা একটি ভুয়া চিঠিও তিনি প্রদর্শন করেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অনুদান নিতে আগ্রহী গল্প বলে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস অর্জন করেন। ময়মনসিংহে চার হাজার বিঘা জমি রয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি। সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা তার সহযোগীরাও এসব গল্প বলে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করেন। প্রতারণার অভিযোগে দেশের বিভিন্ন থানায় সাইফুল ইসলাম ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে এক ডজনের বেশি মামলা রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাইফুল ইসলামের প্রতিষ্ঠিত রাজা বাদশা গ্রুপের কোনো অস্তিত্ব নেই। প্রতারণা করতেই রাজা বাদশা গ্রুপের নামে একটি ওয়েবসাইট খুলেছেন তিনি। ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী গ্রুপের চেয়ারম্যান তিনি নিজেই। তাঁর স্ত্রী, দুই পুত্র ও এক পুত্রবধূ এই গ্রুপের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন। ওয়েবসাইটে প্রতিষ্ঠানটির উত্তরার সোনারগাঁও জনপথ মোড়ে যে ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে, বাস্তবে এর অস্তিত্ব নেই। এমনকি টাঙ্গাইলে রাজা বাদশা টাওয়ার নামে প্রতিষ্ঠানটির যে ঠিকানা দেওয়া হয়েছে, তারও অস্তিত্ব নেই।
টাঙ্গাইল থেকে স্নাতক পাস সাইফুল নিজেকে বিজ্ঞানী দাবি করে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছেন। ভুক্তভোগীরা বলছেন, সাইফুল নানা আবিষ্কারের গল্প বলেন। ১০ বছর আগে তিনি এমন একটি জেনারেটর আবিষ্কার করেছেন, যা বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস ছাড়াই চলে। কথিত এই জেনারেটর বাজারজাত করার নাম করে অনেক মানুষের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। জলবায়ু প্রকল্পের নাম করেও বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। পৃথিবীকে করোনামুক্ত করতে তিনি একটি ফর্মুলা আবিষ্কার করেছেন। বিনিয়োগকারী পেলে তাঁর এসব আবিষ্কারের সুফল সারা বিশ্বের মানুষ পাবে।
এ জন্য বিনিয়োগকারী দরকার। তাঁর এসব প্রকল্পে এখন অল্প পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করলে পরে ফেরত আসবে অনেক বেশি পরিমাণ অর্থ। একসময় তাঁরা বুঝতে পারেন সাইফুল ইসলাম যা বলেছেন, পুরোটাই ভুয়া।
গাজীপুরের ব্যবসায়ী রাকিব সরকার প্রথম আলোকে বলেন, পরিচিত এক ব্যক্তির মাধ্যমে সাইফুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। সাইফুল জলবায়ু প্রকল্প তৈরির কথা বলে তাঁর সহায়তা চান। তাঁকে সাইফুল বলেন, এই প্রকল্পের টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে আটকে আছে। একটু জটিলতা হচ্ছে, তাৎক্ষণিকভাবে কিছু টাকা দরকার। রাকিব দাবি করেন, ‘এভাবে দফায় দফায় আমার কাছ থেকে সাড়ে ১৭ লাখ টাকা নেন সাইফুল। এ সময় আমাকে জলবায়ু প্রকল্পে ইট–বালু সরবরাহের ওয়ার্ক অর্ডারও দেন তিনি। পরে বুঝতে পারি এ ধরনের কোনো প্রকল্পই নেই। আমি প্রতারিত হয়েছি। আমাদের এলাকার অনেকেই বিনিয়োগ করে প্রতারিত হয়েছেন।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সাইফুল ইসলাম বলেন, উষ্ণতা বাড়ার ফলে বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠে পানির উচ্চতা বাড়ছে। ফলে বাংলাদেশসহ অনেক দেশ একসময় ডুবে যাবে। তার ফর্মুলা হচ্ছে সমুদ্রে অনেক ডুবোচর আছে। এগুলো খনন করলে বরফ গলে বেড়ে যাওয়া পানি সেখানে চলে যাবে। এই ফর্মুলা বিশ্বনেতারা গ্রহণ করেছেন।
তবে এ বিষয়ে কোনো গবেষণাপত্র দেখাতে পারেননি সাইফুল। করোনা নির্মূলের ফর্মুলা বা জ্বালানিবিহীন জেনারেটর আবিষ্কারের বিষয়েও কোনো গবেষণা নেই তাঁর। সাধারণ মানুষের কাছ প্রতারণা করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়ে সাইফুল বলেন, তিনি কোনো প্রতারণা করছেন না। এই টাকা পরে তিনি ফেরত দেবেন। ময়মনসিংহে চার হাজার বিঘা জমির বিষয়ে তাঁর বক্তব্য, ওই জমি এক ব্যক্তি তাঁকে উইল করে দিয়ে গেছেন। তবে এ–সংক্রান্ত কোনো প্রমাণ তিনি দেখাতে পারেননি।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন প্রথম আলোকে বলেন, অভিনব কৌশলে প্রতারণা করে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে, এমন একটি চক্রের বিষয়ে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। কয়েকজনকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তাঁদের আইনের আওতায় আনা হবে।