ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থা
‘গচ্চা’র পথে ৫২ কোটি টাকা
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন ট্রাফিক সংকেতব্যবস্থা চালুর প্রকল্পের মেয়াদ বেড়েছে চারবার। এখন চালু করা নিয়েই সংশয়।
রাস্তায় বসানো সরঞ্জাম তিন বছর ধরে অলস পড়ে আছে।
কম্পিউটার চুরি হয়েছে। মামলার তদন্তে অগ্রগতি নেই।
কাটা পড়েছে তার।
রাজধানীর চারটি মোড়ে সড়কে পরীক্ষামূলকভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন ট্রাফিক সংকেতব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজ শুরু হয় সাত বছর আগে। যদিও এ ব্যবস্থা এখনো চালু হয়নি। ইতিমধ্যে প্রকল্পের ব্যয় ১৫ কোটি টাকা বেড়ে ৫২ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। মেয়াদ বেড়েছে চারবার।
ঢাকায় এ পদ্ধতির সংকেতবাতি আদৌ চালু করা সম্ভব হবে কি না, তা নিয়েই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁদের মতে, ঢাকার মতো শহরের জন্য এ ব্যবস্থা বাস্তবসম্মত নয়। সব মিলিয়ে রাজধানীর ট্রাফিক সংকেতবাতি ব্যবস্থায় অপচয়ের তালিকায় নতুন করে যুক্ত হতে যাচ্ছে এ প্রকল্প।
রাজধানীর যানজট নিরসনে এবং শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থার আধুনিকায়নে ২০১৫ সালে ‘ঢাকা ইন্টিগ্রেটেড ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট’ নামে প্রকল্পটি নেয় ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। মেয়াদ ছিল ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত। চার দফা বাড়ানোর পর সর্বশেষ মেয়াদ নির্ধারণ করা হয় আগামী জুন পর্যন্ত। এখন মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানোর আবেদন করেছে ডিটিসিএ। প্রকল্পটিতে প্রায় ১৯ কোটি টাকা ঋণসহায়তা দিচ্ছে জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। বাকি অর্থ দেবে সরকার।
ডিটিসিএর অতিরিক্ত নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রবিউল আলম প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পটি নিয়ে আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু বলা যাচ্ছে না।
প্রকল্পের আওতায় ২০১৯ সালে গুলশান-১, মহাখালী, পল্টন ও ফুলবাড়িয়া (গুলিস্তান) মোড়ে কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তা বা ইন্টেলিজেন্ট ট্রাফিক সিস্টেমের (আইটিএস) জন্য ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা, ভিডিও ক্যামেরা, অত্যাধুনিক শব্দধারণ যন্ত্র, বাতি, বিশেষায়িত তার এবং খুঁটি স্থাপন করা হয়। তিন বছরের বেশি সময় ধরে এসব অলস পড়ে আছে। কথা ছিল এ ব্যবস্থায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় ছবি ও শব্দের ভিত্তিতে যানবাহনের চাপ নির্ধারণ করা হবে। যানবাহনের চাপের ভিত্তিতে সংকেতবাতি জ্বলবে-নিভবে।
সম্প্রতি গুলশান-১ ও পল্টন মোড়ে গিয়ে দেখা যায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন সংকেতবাতিগুলো বন্ধ। খুঁটিতে ক্যামেরা লাগানো রয়েছে, কিন্তু সচল নয়। এসব বাতির নিচে দাঁড়িয়ে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা হাতের ইশারায় যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছেন।
তার অপসারণ করেছে কেব্ল টেলিভিশন ও ইন্টারনেট সেবাদাতারা। তাদের কারণে ডিটিসিএর তার ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকতে পারে। ডিটিসিএর তার ঝুলন্ত থাকার কথাও নয়। তাদের চিঠির বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।সেলিম রেজা, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)
কম্পিউটারের হদিস নেই
ডিটিসিএতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জাপান থেকে এ প্রকল্পের বিভিন্ন সরঞ্জাম দেশে আসে ২০১৯ সালে। এর মধ্যে ছিল দুটি অত্যাধুনিক কম্পিউটার, যা রাখা হয়েছিল ভাড়া করা একটি গুদামে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে জাপানের একটি বিশেষজ্ঞ দল বাংলাদেশে কাজ করতে আসে। তখন জানা যায়, গুদামে যন্ত্রপাতি নেই। মালামালের চুরির বিষয়ে ডিটিসিএ কর্তৃপক্ষ মামলা করেছিল। নিজেরাও তদন্ত করেছে। তবে তদন্তে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি। মালামালের হদিসও পাওয়া যায়নি।
ডিটিসিএর অতিরিক্ত নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রবিউল আলম প্রথম আলোকে বলেন, মামলার কোনো অগ্রগতি নেই। নতুন করে কম্পিউটার কেনার কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
কাটা পড়েছে প্রকল্পের তার
এদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ২০২০ সালের শেষের দিকে ঢাকায় ঝুলন্ত তার অপসারণে অভিযান শুরু করে। তখন কাটা পড়ে সড়কবাতি প্রকল্পের গুলশান ও মহাখালী এলাকায় বসানো তার। বিষয়টি নিয়ে সিটি করপোরেশন ও ডিটিসিএর মধ্যে কয়েক দফা চিঠি চালাচালি হয়েছে। সমস্যার সমাধান হয়নি।
ডিটিসিএর অতিরিক্ত নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রবিউল আলম প্রথম আলোকে বলেন, তার কাটা পড়ায় প্রকল্পের পুরো নেটওয়ার্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেই নেটওয়ার্ক আর ঠিক হয়নি। দুই সিটিকে চিঠি দিয়ে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সেলিম রেজা প্রথম আলোকে বলেন, তার অপসারণ করেছে কেব্ল টেলিভিশন ও ইন্টারনেট সেবাদাতারা। তাদের কারণে ডিটিসিএর তার ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকতে পারে। ডিটিসিএর তার ঝুলন্ত থাকার কথাও নয়। তাদের চিঠির বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
একেবারেই অযৌক্তিকভাবে এ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। জনগণের অর্থ খামখেয়ালিভাবে ব্যয় করার দায়ে ডিটিসিএকে জবাবদিহি করতে হবে। তিনি বলেন, জবাবদিহি নেই বলেই অসাধু কর্মকর্তারা বারবার এমন প্রকল্প নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন।অধ্যাপক সামছুল হক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের
অযান্ত্রিক যানের উপযোগী নয়
ডিটিসিএর কর্মকর্তারা বলছেন, অযান্ত্রিক যানবাহনের ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবস্থা কার্যকর নয়। পল্টন ও ফুলবাড়িয়া এলাকায় অযান্ত্রিক যানবাহন বেশি চলাচল করে। এ দুটি এলাকায় অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল বন্ধের পরামর্শ দিয়েছেন জাপানি বিশেষজ্ঞরা। ডিটিসিএ বলছে, প্রকল্প শুরুর সময় কেন অযান্ত্রিক যানবাহনের বিষয়টি মাথায় রাখা হয়নি, সেটি বড় প্রশ্ন।
এর বাইরে ঢাকার যানজট নিরসনে আধুনিক ট্রাফিক সিগন্যালের কাজে গত ২২ বছরে কয়েকটি প্রকল্পে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। কিন্তু যানবাহন চলে ট্রাফিক পুলিশের হাতের ইশারায়।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সংকেতব্যবস্থা কার্যকর করতে হলে যেসব শর্ত পূরণ করা দরকার, ঢাকায় সেগুলো নেই বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, একেবারেই অযৌক্তিকভাবে এ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। জনগণের অর্থ খামখেয়ালিভাবে ব্যয় করার দায়ে ডিটিসিএকে জবাবদিহি করতে হবে। তিনি বলেন, জবাবদিহি নেই বলেই অসাধু কর্মকর্তারা বারবার এমন প্রকল্প নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন।