খেতাববঞ্চিত এক বীরের কথা
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এ দেশে যে অসংখ্য বীরের জন্ম দিয়েছে, চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার আমিরাবাদের সন্তান মেজর নাজমুল হক ছিলেন তঁাদের একজন। রাষ্ট্রীয় বীর খেতাব না পেলেও জনতার কাছে তিনি একজন প্রকৃত বীর
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর কিছুদিন আগের কথা। ১৯৭১ সালের ১৮ মার্চ ৭ ইপিআর উইংয়ের অধিনায়ক করে মেজর নাজমুল হককে পাঠানো হয় নওগঁায়। মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে সারা দেশ তখন ফুঁসছে ক্ষোভে। পাকিস্তানি শাসন-শোষণ থেকে মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের প্রস্তুতি নিচ্ছে জনতা।
এমন পরিস্থিতিতে পাঞ্জাবি উইং কমান্ডার মেজর আকরাম কোনো বাঙালির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরে প্রথমে রাজি হননি। পরে বাধ্য হয়ে তিনি মেজর নাজমুল হককে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকায় গণহত্যার মাধ্যমে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামকে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল। নওগঁায় সে খবর পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে নাজমুল হক স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। ২৬ মার্চ নওগঁা মহকুমা মুক্তাঞ্চল ঘোষণার মাধ্যমে শুরু হয় তঁার মুক্তিযুদ্ধ।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এ দেশে যে অসংখ্য বীরের জন্ম দিয়েছে, চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার আমিরাবাদের সন্তান মেজর নাজমুল হক ছিলেন তঁাদের একজন। রাষ্ট্রীয় বীর খেতাব না পেলেও জনতার কাছে তিনি একজন প্রকৃত বীর। মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে তিনি সম্মুখযুদ্ধেই কেবল অংশ নেননি, একই সঙ্গে স্থানীয় যুবকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছেন লড়াই করার জন্য। ৭ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল—দশম খণ্ড ও মেজর রফিকুল ইসলামে লেখা লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে বইতে শহীদ মেজর নাজমুলের বীরত্বের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
১৯৩৮ সালের ১ আগস্ট চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার আমিরাবাদ গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম তঁার। বাবা হাফেজ আহমেদ ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট। তিন ভাইয়ের মধ্যে নাজমুল ছিলেন দ্বিতীয়। শিক্ষাজীবন শুরু করেন গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। কুমিল্লার ঈশ্বর পাঠশালা থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। এরপর ঢাকার আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট) ভর্তি হন। কিন্তু দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত অবস্থায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর বেঁচে ছিলেন তিনি মাত্র ছয় মাস। এই ছয় মাসে সাত নম্বর সেক্টরের অধীনে সমগ্র রাজশাহী, পাবনা ও বগুড়া জেলা, দিনাজপুর ও রংপুরের কিছু এলাকায় অসংখ্য অভিযান পরিচালনা করেন। ইপিআর সদস্য ও স্থানীয় যুবকদের সঙ্গে নিয়ে নওগঁা ও বগুড়ার সেনা ক্যাম্পে হামলা করেন তিনি। শত্রুমুক্ত করেন সমগ্র বগুড়া জেলা। এরপর গ্রহণ করেন রাজশাহী ও চঁাপাইনবাবগঞ্জ মুক্ত করার পরিকল্পনা।
বগুড়া ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৯১ আইএপি (ইনডিপেনডেন্ট এমুনেশন প্লাটুন)। রংপুরে অবস্থিত ২৩ ব্রিগেডের যাবতীয় গোলাবারুদের সঞ্চিত রাখা হতো এখানেই। মেজর নাজমুল হক প্রথমে এই প্লাটুনের গোলাবারুদ যেন শত্রুর নিয়ন্ত্রণে না যায় তা নিশ্চিত করেন। এরপর বিস্তৃত অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন। বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে ছাত্র ও যুবকদের সংগঠিত করতেন। কাছাকাছি কোনো স্কুলের মাঠে চলত প্রশিক্ষণ পর্ব। মুক্তিযুদ্ধকে একটি গণযুদ্ধের দিকে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা থেকেই তিনি প্রথম থেকে উদ্যোগী ছিলেন।
মেজর নাজমুল হক যে ৭ নম্বর সেক্টরের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন, সেই সেক্টরে প্রায় ১৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ করেন। নিয়মিত বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় আড়াই হাজার এবং সাড়ে বারো হাজার মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন গণবাহিনীর সদস্য। এই সেক্টরের আটটি সাব–সেক্টর ছিল। প্রতিটি সাব-সেক্টরের অপারেশনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকতেন। অনেক সময় তিনি নিজেই অভিযানে নেতৃত্ব দিতেন।
১৯৭১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনাসংক্রান্ত শিলিগুড়িতে একটি বৈঠক থেকে ফেরার পথে দুর্গম পাহাড়ি পথে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান মেজর নাজমুল। পরবর্তী সময়ে মেজর কাজী নুরুজ্জামান সাত নম্বর সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
মেজর নাজমুল হক মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য কোনো রাষ্ট্রীয় সম্মাননা না পাওয়ায় হতাশ তঁার পরিবারের সদস্যরা। এ ব্যাপারে মেজর নাজমুল হকের চাচাতো ভাই এস এম মঞ্জুরুল হক বলেন, ‘আমরা শহীদ সেক্টর কমান্ডার মেজর নাজমুলের স্মৃতি রক্ষায় তঁার নামে ১৯৮৮ সালে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করি। ভবিষ্যতে এই বিদ্যালয়কে উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পরিণত করার ইচ্ছে রয়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের অর্থায়নে তঁার নামে একটি পাঠাগারও চালু হলেও এটি নিয়মিত খোলা থাকে না। এসব ছাড়া তিনি রাষ্ট্রীয় কোনো সম্মাননা পাননি। ফলে মুক্তিযুদ্ধে তঁার অবদানও যথাযথভাবে মূল্যায়িত হয়নি বলে আমরা মনে করি।’
মেজর নাজমুল হকের মেয়ে নওরীন সাবা প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাবা যখন মারা যান তখন আমরা খুব ছোট। বাবা আমাদের দুই বোনকে খুব আদর করতেন। আমার বাবা একজন সেক্টর কমান্ডার হলেও তঁাকে সেভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। অথচ তিনিই একমাত্র সেক্টর কমান্ডার, যিনি যুদ্ধকালীন শহীদ হয়েছিলেন। তিনি এ দেশেরই গর্ব। রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পেলে আমরা বর্তমান সরকারের নিকট কৃতজ্ঞ থাকব।’
মুক্তিযুদ্ধের গবেষক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক চৌধুরী শহীদ কাদের প্রথম আলোকে জানান, একজন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে নাজমুল হক ছিলেন দক্ষ সংগঠক। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার আগে তঁার পরিবারের সদস্যদের কোনো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ জানানো হতো না।
লোহাগাড়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আখতার আহমদ সিকদার বলেন, ‘একজন সেক্টর কমান্ডার দীর্ঘদিন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পাওয়া সত্যিই দুঃখজনক। আমাদের দাবি, চট্টগ্রামের তৃতীয় কর্ণফুলী সেতুটি তঁার নামে হোক। আমরা চাই, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নতুন প্রজন্ম জানুক এবং এ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ মূল্যায়ন হোক।’
মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক মাহফুজুর রহমানকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে প্রথম আলোকে তিনি জানান, সেক্টর কমান্ডার হিসেবে মেজর নাজমুলের বীর উত্তম খেতাব পাওয়া উচিত ছিল। রাষ্ট্রের উচিত এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে যথাযথ সম্মান জানানো।