নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকেও বলা হচ্ছিল, শিক্ষার্থীরা চোখ খুলে দিয়েছে। ঈদযাত্রায় সড়কে মৃত্যুর মিছিল এবং সাম্প্রতিক সড়ক-নৈরাজ্য দেখে মনে হচ্ছে, রাজপথে নেমে শিক্ষার্থীরা যে চোখ খুলে দিয়েছিল, তা আবার বন্ধ হয়ে গেছে।
গতকাল শুক্রবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে আলোচকেরা এসব কথা বলেন। ঈদুল আজহার সময় সংঘটিত সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করে দুর্ঘটনার প্রতিবেদন তৈরি করেছে সমিতি। লিখিত বক্তব্য দেন সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী।
বক্তব্যে বলা হয়, এবার ১৬ থেকে ২৮ আগস্ট ১৩ দিন ঈদযাত্রা বলে ধরা হয়েছে। এই সময়ে সড়ক, রেল ও নৌপথে মোট ২৭০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছে ২৭৮ জন। দুর্ঘটনার বেশির ভাগই ঘটেছে সড়কপথে। ২৩৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ২৫৯ জন। আহত হয়েছে ৯৬০ জন। আর রেলপথে ১৯টি দুর্ঘটনায় ১৫ এবং নৌপথে ১৪টি দুর্ঘটনায় ৪ জন নিহত হয়েছে। নৌ-দুর্ঘটনায় ৮ জন এখনো নিখোঁজ। তাঁদের নিহত ব্যক্তিদের তালিকায় ধরা হয়নি। সড়ক দুর্ঘটনার বেশির ভাগই ঘটেছে বাসে, ২৯ দশমিক ১৮ শতাংশ। কাভার্ড ভ্যান ও ট্রাক দুর্ঘটনা ২৩ দশমিক ৬ শতাংশ। আর মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ১৬ দশমিক ৭২ শতাংশ।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, বেপরোয়া গতি, পণ্যবাহী পরিবহনে যাত্রীবহন, অদক্ষ চালক, বিরতিহীন গাড়ি চালানো, নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মহাসড়কে নছিমন-করিমনজাতীয় ছোট যানের চলাচলের কারণে দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে।
গত ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হয়। সেদিন থেকে নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দেয়।
সরকারের প্রতিশ্রুতির পরও সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামছে না। ঈদযাত্রায় সড়কে নিহত ব্যক্তিদের সংখ্যা এবং চট্টগ্রামে বাস থেকে ফেলে যাত্রী হত্যা, কুষ্টিয়ায় বাসের ধাক্কায় মায়ের কোলে থাকা শিশুর মৃত্যুর মতো সাম্প্রতিক নৈরাজ্য দেখে হতাশা প্রকাশ করেন আলোচকেরা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর সড়ক নিরাপদ করতে সরকার নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে পরিস্থিতি বদলাচ্ছে না বলে তাঁরা মনে করেন।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও নিরাপদ সড়কের জন্য গঠিত জোট ‘সেভ রোড অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট অ্যালায়েন্স’ (স্রোতা)-এর আহ্বায়ক হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয় বা নেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু জবাবদিহির জায়গাটি কখনোই নিশ্চিত করা হয় না।
সরকারের দুজন মন্ত্রীর পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সমিতির নেতৃত্বে থাকার বিষয়ে ইঙ্গিত করে হোসেন জিল্লুর বলেন, ‘যিনি নীতিনির্ধারণ করছেন, তিনি বা তাঁরা একাধারে মালিক ও শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধিত্বও করছেন। সুতরাং জবাবদিহির জোরালো দাবি যখন আসে, তখন অবধারিতভাবে তাঁরা তাঁদের বিষয়টা তুলে ধরার চেষ্টা করেন।’ তিনি মনে করেন, নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে জবাবদিহি তৈরির যে জায়গা, সে জায়গাটা দুর্বল করে ফেলছে এই স্বার্থের দ্বন্দ্ব।
পরিবহন খাতের সার্বিক উন্নয়ন ছাড়া সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামানো যাবে না বলে মনে করেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সাবেক চেয়ারম্যান আয়ুবুর রহমান। তিনি বলেন, ৫০ থেকে ৬০টি দিক পরীক্ষা করে একটি গাড়ির ফিটনেস দিতে হয়। পৃথিবীর কোথাও চোখে দেখে যানবাহনের ফিটনেস দেওয়া হয় না। ডিজিটাল ভেহিকল ইনস্পেকশন সেন্টার চালু করতে হবে।
নতুন সড়ক নিরাপত্তা আইন পাস হলেই দুর্ঘটনা কমবে বলে মনে করেন না আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। তাঁর মতে, দেশে আইন মানার চর্চা নেই। আইনের বাস্তবায়ন নিয়ে সবার কথা বলতে হবে। নিজ নিজ জায়গা থেকে নীতিনির্ধারকদের ওপর চাপ তৈরি করতে হবে।
সড়কে দুর্ঘটনা রোধে যাত্রী কল্যাণ সমিতি বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরেছে। এর মধ্যে সড়ক নিরাপত্তা ইউনিট গঠন করে নিয়মিত দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান, প্রশিক্ষিত চালক গড়ে তুলতে সরকারি চালক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু, মহাসড়কে নছিমন-করিমন, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বন্ধে সরকারের সিদ্ধান্ত শতভাগ বাস্তবায়ন, ভাঙাচোরা সড়ক সংস্কার এবং ফিটনেসবিহীন ও ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে হবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধে আইনের প্রয়োগ জোরদার করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনার কারণে দেশের জিডিপির বড় অংশ হারাচ্ছে। এই ক্ষতি কমাতে সড়ক ব্যবস্থাপনায় সঠিক পরিকল্পনা, বিনিয়োগ ও বাস্তবায়ন এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।