খালে পড়া ছালেহ আহমেদ কোথায়, কেউ জানে না

চট্টগ্রামে খালে পড়ে যাওয়া পথচারীর খোঁজ এখনো পাওয়া যায়নি
ফাইল ছবি

২০ দিন আগে পা পিছলে খালে পড়ে গিয়েছিলেন ছালেহ আহমেদ। টানা বৃষ্টিতে প্রতিবছরের মতো এবারও চট্টগ্রাম নগরে জলাবদ্ধতা হয়। পানিতে সড়ক ও খাল-নালা একাকার হয়ে যায়। দোকানে যাওয়ার পথে গত ২৫ আগস্ট খালে পড়ে যান ছালেহ আহমেদ। এখনো তাঁর খোঁজ পাওয়া যায়নি। তিনি বেঁচে আছেন, না মারা গেছেন, মারা গেলে তাঁর লাশ কোথায় আটকে আছে, নিশ্চিত করে বলতে পারছে না ফায়ার সার্ভিস।

পরিবার ছালেহ আহমেদের বেঁচে থাকার আশা ছেড়ে দিয়েছে। তারা চায় ছালেহ আহমেদের লাশের কিছু অংশ। তাহলে অন্তত কবর তো দিতে পারবে। ছালেহ আহমেদের মা জাহানারা বেগমের (৮০) হাহাকার এখনো থামেনি। ঘুমের ঘোরেও তিনি ‘অ পুত’, ‘অ পুত’ বলে চিৎকার করে ওঠেন। প্রথম আলোকে বলেন, নিখোঁজের আগের রাতে ফোন করেছিলেন ছেলে। পরদিন মাইজভান্ডারে যাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু ছেলে যে এভাবে হারিয়ে যাবেন, তা তিনি জানতেন না।

ছেলের জন্য মায়ের কান্না থামছিল না। এই কান্না ছড়িয়ে পড়ে পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যেও। কান্নাজড়িত কণ্ঠে মায়ের আকুতি, ‘পুতরে তো আর জ্যাঁতা ন ফাইওম। আড্ডি যদি ফাইতাম, কবর অইলে দিইয়ারে শান্তি ফাইতাম। (ছেলেকে তো আর জীবিত পাব না। তাঁর হাঁড় যদি পেতাম, তা কবর দিয়ে শান্তি পেতাম।)’

ছেলে হারানোর কি সান্ত্বনা হয়? স্বজন আর পাড়া-প্রতিবেশীদের শত আশ্বাসেও মায়ের মনের দুঃখ দূর হচ্ছে না। ছেলে যে জীবিত ফিরে আসবেন—এই আশা দুরাশায় পরিণত হয়েছে। এখন অপেক্ষা কোনো রকম লাশটি ফিরে পাওয়ার। কিন্তু তা-ও যেন দিন দিন ধূসর হয়ে পড়ছে।

চট্টগ্রাম নগরের চকবাজার কাঁচাবাজারে সবজির দোকান ছিল ছালেহ আহমেদের। তাঁর গ্রামের বাড়ি পটিয়ার মনসা গ্রামে। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার মাইজভান্ডার দরবার শরিফে যাওয়ার জন্য মুরাদপুরে এসেছিলেন তিনি। ওখান থেকে বাসে দরবার শরিফে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই পানিতে তলিয়ে যান। স্ত্রী-সন্তান গ্রামের বাড়িতে থাকলেও তিনি নগরের চকবাজারে ভাড়া বাসায় থাকতেন।

গত শনিবার দুপুরে ছালেহ আহমেদের গ্রামের বাড়িতে যান প্রথম আলোর প্রতিনিধি। নিখোঁজ ছালেহ আহমেদের ছেলে ও ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন মা জাহানারা বেগম। ছেলের জন্য বিলাপ শুরু করে দেন ওই বৃদ্ধা।

টিন ও মাটির তৈরি জীর্ণ বাড়ি ছালেহ আহমেদের। সেখানেই থাকেন স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস, ছেলে ছাদেক উল্লাহ মাহিন ও মেয়ে জান্নাতুল মাওয়া। ঘরের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির এই করুণ পরিণতিতে সবার মধ্যে নেমে এসেছে বিষাদ আর অনিশ্চয়তা।

বাবা মাইজভান্ডার যাবেন—এ জন্য দোকানে বসতে গ্রাম থেকে এসেছিলেন ছেলে ছাদেক। দোকানে থাকাকালে লোকজন জানান, তাঁর বাবা খালের পানিতে ভেসে গেছেন। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসেছিলেন। কিন্তু অনেক চেষ্টায়ও বাবাকে খুঁজে পাননি ছাদেক। এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছাদেক উল্লাহ বলেন, ‘বাবার আয়ের ওপর নির্ভরশীল আমরা। কিন্তু এখনো বাবার খোঁজ পাচ্ছি না। এখন কীভাবে আমাদের সংসার চলবে, কীভাবে পড়াশোনার খরচ চলবে—সে চিন্তায় আমরা দিশেহারা।’ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী তাঁকে চাকরির আশ্বাস দিয়েছেন বলে জানান তিনি।

ছালেহ আহমেদরা চার ভাই। গ্রামে আলাদা আলাদা বাড়িতে থাকেন সবাই। শনিবার দুপুরে ছালেহ আহমেদের বাড়িতে ছিলেন দুই ভাই মনির আহমেদ ও ফোরকান আহমেদ। নিখোঁজের এত দিনেও ভাইয়ের খোঁজ না পাওয়ায় ক্ষোভ রয়েছে তাঁদের মধ্যে। প্রথম আলোকে তাঁরা জানান, ভাইয়ের খোঁজে নিজেরাই খালে নেমেছিলেন। খুঁজেছিলেন চশমা খাল এবং এর সঙ্গে যুক্ত মির্জা খালেও। কর্ণফুলী নদীতে খোঁজ করেছেন। কিন্তু কোথাও ভাইয়ের দেখা মেলেনি। সবার সামনে ভেসে গেলেন ভাই। এখন সে ভাইয়ের দেখা আর কবে মিলবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।

তবে তলিয়ে যাওয়া ছালেহ আহমেদের উদ্ধারে হাল ছেড়ে দিতে রাজি নন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। নগরের আগ্রাবাদ ফায়ার স্টেশনের জ্যেষ্ঠ স্টেশন কর্মকর্তা এনামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর কর্মজীবনে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে বলে মনে পড়ছে না। সচরাচর তলিয়ে যাওয়ার কয়েক দিন পরেই লাশ ভেসে ওঠে বা খোঁজ পাওয়া যায়। কিন্তু ছালেহ আহমেদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। সম্ভাব্য সব জায়গায় তল্লাশি করা হয়েছে। স্থানীয় জনগণের সহায়তাও নেওয়া হচ্ছে। তাঁর ধারণা, পানিতে ভেসে যাওয়া ছালেহ আহমেদের দেহ মাটি বা বালুর স্তূপের নিচে চাপা পড়ে থাকতে পারে। খোঁজ না পাওয়া পর্যন্ত অভিযান চলমান থাকবে।