খাদ্যসংকটের সমাধান এবং আলু সমাচার
শিরোনামটা দেখে অনেকেই হয়তো ভ্রুকুটি করে উঠবেন। ভাবছেন, খাদ্যনিরাপত্তার সঙ্গে আলুর কী সম্পর্ক? আসলে কেবল খাদ্য হিসেবে নয়, শব্দ হিসেবেও আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আলুর যে বহুবিধ ব্যবহার, তাতে সাধারণত আমাদের মনোজগতে আলুর সঙ্গে কোনো সিরিয়াস বিষয় যায় না, তাই না? এ ধরনের মনোভাবকে মনোবিজ্ঞানীরা ‘ক্ল্যাসিক্যাল কন্ডিশনিং’ বলে থাকেন। কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক: কেউ যদি দেখতে নাদুসনুদুস হন, বন্ধুরা তাকে আদর করে ‘আলু’ বলে ডাকেন। আবার কেউ যদি একটু বোকাসোকা হন, তাকেও আমরা ‘আলু’ বলে ডাকি। আর ‘আলুর দোষ’ বললে তো চারদিকে রি-রি পড়ে যায়।
যাহোক, আজকের আলোচনার মূলে যাওয়া যাক।
সিরিয়া, ইয়েমেন, লেবাননসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলমান সহিংসতা; কঙ্গো, সুদান, ইথিওপিয়াসহ আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশে পঙ্গপালের আক্রমণ এবং দীর্ঘস্থায়ী খরা পরিস্থিতির কারণে বিশ্বে আজ বিরাজ করছে এক ভয়ানক খাদ্যসংকট। অবিশ্বাস্য হলেও এটাই নির্মম বাস্তবতা যে এখনো এই পৃথিবীতে প্রতিরাতে ১০ শতাংশের বেশি মানুষ, যার সংখ্যা প্রায় ৮২ কোটি, খিদে পেটে ঘুমোতে যায়। প্রায় ১৩.৫ কোটি মানুষ অনাহারে দিন কাটায়।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) সম্প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছে, এক ভয়ানক দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হচ্ছে আমরা। এখনই যদি যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, তবে অদূর ভবিষ্যতে এক চরম মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ব আমরা। খাদ্যের অভাবে প্রতিদিন প্রাণ হারাবে ৩ লাখ নিরীহ মানুষ। করোনাভাইরাস সৃষ্ট সংকটের কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে যাওয়ায় আরও প্রায় ১৩ কোটি মানুষ যুক্ত হবে অনাহারীর তালিকায়। কোটি টাকার প্রশ্ন, করণীয় কী?
আসন্ন এই মহাদুর্যোগ মোকাবিলা করতে হলে বিশ্বকে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। কোনো একক রাষ্ট্র বা সংস্থার পক্ষে একা এই সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে চলমান মহামারি রোধে আমরা সে রকম কোনো উদ্যোগ দেখিনি। প্রতিটি দেশ তার নিজের মতো করে চেষ্টা করছে।
খাদ্যসংকট বা দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় প্রথমে আমাদের নজর দিতে হবে খাদ্য উৎপাদন এবং এর সরবরাহ পরিস্থিতির দিকে। সর্বপ্রথমে এমন একটা শস্য নির্বাচন করতে হবে, যা পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে চাষ হয়, যেটি উপাদেয়, পুষ্টিকর এবং অধিক উৎপাদনশীল। কোন সে ফসল? উত্তর—আলু। কেন?
- পৃথিবীর ১৫৯টি দেশে আলু চাষ হয়। এর চাষের পদ্ধতি তেমন জটিল নয়। অনায়াসে এই ফসল ফলানো সম্ভব।
- আলু একটি সুষম ও পুষ্টিকর খাদ্য, যাতে রয়েছে ভিটামিনসহ সব ধরনের পুষ্টি উপাদান। বিশ্বখ্যাত চিকিৎসক এবং লেখক স্ট্যানলি ডেভিডসনের মতে, আলু অন্যান্য প্রধান খাদ্যের চেয়ে উৎকৃষ্ট, কেননা এতে রয়েছে অধিক ভিটামিন ও পুষ্টি। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের মতে, একটি খোসাসহ ১৫০ গ্রাম ওজনের আলুতে রয়েছে ২৯. ৫৫ মিলিগ্রাম ভিটামিন ‘সি’, যা চাল বা গমে নেই। এ ছাড়া একটি মাঝারি আকৃতির আলুতে থাকে ৬৩২ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম, ০.৪৪ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি ৬, যথেষ্ট পরিমাণে থিয়ামিন, রিবোফ্লাভিন, ফলেট, নিয়াসিন, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস, আয়রন ও জিংক। ভিটামিন সি থাকায় আলু শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়। এই ভিটামিন সি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। এ ছাড়া আলুতে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, অ্যামাইনো অ্যাসিড, ওমেগা-থ্রিসহ নানা ধরনের ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে, যা মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়ায়। এটি ত্বকের জন্যও ভালো। পাশাপাশি হৃদ্রোগ মোকাবিলায় সহায়তা করে ও রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখে।
- আলুকে বলা হয় ‘কিং অব ভেজিটেবল’। এর রয়েছে নানাবিধ মুখরোচক ব্যবহার। ফলে খাদ্য হিসেবে বিশ্বব্যাপী এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে।
এবার আসা যাক উৎপাদনশীলতার কথায়। হেক্টর (৭.৫ বিঘা) প্রতি আলুর গড় ফলন ২০ টন; অন্যদিকে ধান ০৩ টন আর গম ৩.৩ টন। সুতরাং এই বিবেচনায় আলু অন্যান্য প্রধান ফসলের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে। তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? যত বেশি জমিতে আলু চাষ হবে, ফলন হবে ধান বা গমের তুলনায় প্রায় ৭ গুণ বেশি, যা দিয়ে অধিকসংখ্যক মানুষের ক্ষুধা নিবারণ সম্ভব, তাই না?
সুতরাং, বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে অবিলম্বে যা করতে হবে:
- আলুকে সংকট মোকাবিলার প্রধানতম ফসল হিসেবে ঘোষণা করা।
- আরও অধিকসংখ্যক জমি আলু চাষের আওতায় নিয়ে আসা। এ ব্যাপারে প্রতিটি দেশকে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিতে হবে।
- উন্নত মানের আলুর বীজ সরবরাহ করা।
- চাষের জন্য প্রয়োজনীয় সার, বালাইনাশকসহ যাবতীয় কৃষি উপকরণের প্রাপ্তি নিশ্চিত করা।
- যেসব দেশে চাহিদার তুলনায় উদ্বৃত্ত উৎপাদন করবে, তাদের অতিরিক্ত আলু যেখানে ঘাটতি রয়েছে, সেখানে সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।
সরবরাহ পরিস্থিতি উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে চাহিদার দিকেও নজর দিতে হবে। প্রান্তিক বা নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য হ্রাসকৃত মূল্যে এবং চরম দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বিনা মূল্যে আলু সরবরাহ করতে হবে।
সময় এসেছে আজ সারা পৃথিবীকে এক হয়ে এই মহাদুর্যোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার। আমরা যদি ব্যর্থ হই, ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।
শেষটা নাহয় একটা কৌতুক দিয়ে হোক। আলু দিয়ে বারো পদের তরকারি রান্নার পর ভাগিনার উদ্দেশে করে মামির সপ্রতিভ উক্তি, ভাগিনা, আসলি আনসিজনে, আলুর সিজনে তো আসলি না!’
* সাজ্জাদুল হাসান, লালমাটিয়া, ঢাকা। [email protected]