ক্ষতিপূরণ আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে

ঘরবাড়ি হারানো পরিবারগুলোকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। শরীয়তপুরের জাজিরার নাওডোবায়
প্রথম আলো

পদ্মা সেতুর জন্য ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনকাজ নিজস্ব অর্থায়নে করতে হবে, এটা আগে থেকেই জানা ছিল। কারণ, জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনে উন্নয়ন সহযোগীরা অর্থায়ন করে না।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের প্রাথমিক প্রস্তুতি শুরু হয় ২০০৬ সাল থেকেই। আর জমি অধিগ্রহণ শুরু হয় ২০০৯ সালে।

দেশে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে সময়ক্ষেপণের পেছনে একটি বড় কারণ জমি অধিগ্রহণে জটিলতা, মামলা ও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে অনিয়ম। পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা জাইকা ও ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) ঋণ দেওয়ার কথা ছিল।

সাধারণত আন্তর্জাতিক সংস্থার ঋণে প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে জমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ও পরিবেশগত প্রভাব বিষয়ে সংস্থাগুলোর নীতিমালা মানতে হয়। পদ্মা সেতু প্রকল্পে শেষ পর্যন্ত বিদেশি ঋণ না নেওয়া হলেও আন্তর্জাতিক সব মানদণ্ড মেনে এসব কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের অধীনে ২ হাজার ৬৮৮ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এর প্রায় অর্ধেকই মাদারীপুর জেলায় পড়েছে। বাকিটা মুন্সিগঞ্জ ও শরীয়তপুরে। জমি অধিগ্রহণের পেছনে ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৪১ কোটি টাকা।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের সামাজিক প্রভাব–সম্পর্কিত সমীক্ষা অনুসারে, প্রকল্পের কারণে ১৫ হাজার ৫০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর প্রায় সাড়ে আট হাজার কৃষক পরিবার। সব মিলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যসংখ্যা প্রায় ৮৬ হাজার। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তত পাঁচ হাজার পরিবার ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়। বাকি সাড়ে ১০ হাজার পরিবার বসতবাড়ি নয়, কৃষিজমি হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রতিবেদন অনুসারে, মাওয়া প্রান্তে সেতু এলাকার ৭০ শতাংশ পরিবার ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা সেবা খাতের সঙ্গে জড়িত। মাত্র ৫ শতাংশ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। জাজিরা প্রান্তে ৫০ শতাংশই কৃষির সঙ্গে যুক্ত।

তবে ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেককেই ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন সহায়তা এবং ক্ষেত্র বিশেষ আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। অনেকেই পেয়েছেন আয়বর্ধক নানা প্রশিক্ষণ। এর মধ্যে সেলাই ও যানবাহন চালানোর প্রশিক্ষণ অর্ন্তভুক্ত ছিল। পদ্মা সেতুর দুই পাড়ে সাতটি পুনর্বাসন এলাকায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ৩ হাজার ১১টি প্লট তৈরি করা হয়েছে। অল্প কিছু বাদে প্রায় সব প্লটই ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ভিটেমাটি হারানো প্রায় দুই হাজার পরিবার প্লট নিতে আগ্রহ দেখাননি। এ ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের নিজেদের জমিতে ভিটা তৈরি এবং বাড়ি করার জন্য তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত অনুদান দেওয়া হয়েছে।

এর বাইরে পুনর্বাসন এলাকায় দুই পারে চারটি বাজার তৈরি করা হয়েছে। এসব বাজারে ১০০টি বাণিজ্যিক প্লট আছে, যা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা পেয়েছেন। চারটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। পাঁচটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র করা হয়েছে পদ্মা সেতু প্রকল্পের টাকায়। প্রকল্প এলাকায় ১৩টি নতুন মসজিদ নির্মাণ এবং তিনটি মসজিদ পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। কবরস্থান নির্মাণ করা হয়েছে তিনটি।

১৯৮২ সালের ভূমি অধিগ্রহণ আইন অনুসারে পদ্মা সেতুর বেশির ভাগ জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ওই অনুসারে, জমির মৌজা মূল্যের দেড় গুণ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান। তবে পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষ বাজারমূল্যে জমি ও স্থাপনার ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। এ জন্য ২০০৯ সালের এপ্রিলে পদ্মা সেতু ভূমি অধিগ্রহণ আইন প্রণয়ন করা হয়। সেতু কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রথমে জমির নিবন্ধন মূল্যের দেড় গুণ সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়।

এরপর বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মাধ্যমে বাজার মূল্য নির্ধারণ করে সেতু বিভাগ। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের বাড়তি অর্থ পরিশোধের জন্য বেসরকারি সংস্থা ক্রিশ্চিয়ান কমিশন ফর ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশকে (সিসিডিবি) নিয়োগ করা হয়। তারা ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে কাজ শুরু করে। তাদের মাধ্যমে বাজারমূল্য অনুযায়ী বাকি অর্থ পরিশোধ করা হয়।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পদ্মা সেতুর জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া ছিল বিশ্বসেরাদের কাতারে। একদম আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া ও পুনর্বাসন করা হয়েছে। কোনো অভিযোগ এলে বা কারও ক্ষতিপূরণ নিয়ে আপত্তি এলে তা যৌক্তিকভাবে সমাধান করা হয়েছে।

সেতু বিভাগের নথি অনুসারে, পদ্মা সেতু প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ পরিকল্পনা (এলএপি), পুনর্বাসন কর্মপরিকল্পনা (আরএপি), পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা (ইএমপি) ২০০৬ সালেই সম্পন্ন করা হয়। আর জমি অধিগ্রহণ শুরু হয় ২০০৯ সালের শুরু থেকেই।

পরিবেশগত সমীক্ষায় প্রকল্পের কারণে দুই লাখের বেশি গাছ কাটা পড়বে বলে উল্লেখ করা হয়। এর বাইরে বাঁশ আর কলাগাছ কাটা পড়েছে চার লাখের মতো। তবে পরিবেশের এই ক্ষতি পোষাতে প্রকল্প এলাকায় চার লাখের বেশি গাছ লাগানোর কথা আছে। এর মধ্যে ১ লাখ ৭৩ হাজার গাছ লাগানো হয়েছে। আরও গাছ লাগানো হবে। একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে সাত লাখ বাঁশ ও কলাগাছের চারা বিতরণ করা হয়েছে।

পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজের কারণে জীববৈচিত্র্যে যে প্রভাব পড়েছে, তা পূরণে বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠায় হচ্ছে। এর জন্য একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পদ্মা সেতু জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে।