রোহিঙ্গা সমস্যার মতো বড় সংকটের সমাধান তিনভাবে হতে পারে। প্রথমত, যেখান থেকে বিতাড়িত হয়েছে, সেখানে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, আদি নিবাসে ফিরে যেতে না পারলে তৃতীয় কোনো দেশে তাদের পুনর্বাসন। তৃতীয়ত, আশ্রিত দেশে তাদের আত্তীকরণ করে নেওয়া। আয়তনের অনুপাতে বাংলাদেশে জনসংখ্যার যে পরিস্থিতি, তাতে রোহিঙ্গাদের এখানে চিরদিনের মতো রেখে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় শেষের সমাধানটির কথা যেভাবে বলছে, প্রথম দুই ধাপের কথা সেভাবে বলছে না।
দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর যে চেষ্টা দুবার হয়েছিল, তাতে ২, ৪ বা ১০ হাজার রোহিঙ্গার ফেরত যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল।
মিয়ানমার প্রথম থেকে ২, ৪ বা ১০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলেছে। দেশটি আন্তর্জাতিকভাবে মুখ রক্ষার স্বার্থে এটিকে পুঁজি করতে চেয়েছিল। এতে কিন্তু বাংলাদেশের কোনো লাভ হবে না। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানও এটি নয়।
রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চার বছরেও আমরা কিন্তু কোনো আশা দেখছি না। সংকট সমাধানে চীন ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগ নিয়েছিল। একমাত্র তাদের পক্ষেই মিয়ানমারকে রাজি করানো সম্ভব। কিন্তু চীন বরাবরের মতো এখনো মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এখানে দেশটির ভূরাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে। শুধু মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর আশ্বাসে রোহিঙ্গারা রাখাইনে ফিরে যাবে না। চীনের রাখাইনে ব্যাপক অবকাঠামো প্রকল্প করার কথা। সেখানে যখন তাদের বিপুল শ্রমিকের প্রয়োজন, রোহিঙ্গারা ফিরে গেলে তা চীনের জন্য সহায়ক হতে পারে। কারণ, অধিকারবঞ্চিত এসব রোহিঙ্গা সস্তা শ্রমে রাখাইনে কাজ করতে রাজি হতে পারে। কিন্তু চীন যে সেটা করবে, এমন কোনো আশা দেখা যাচ্ছে না।
তবে রাখাইনে রোহিঙ্গা গণহত্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে যে মামলা আছে, সেটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ, আদালত মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রাখাইনে গণহত্যার রায় ঘোষণা করলে দেশটি বিপদে পড়বে। পশ্চিমা দেশগুলোসহ যারাই সেখানে বিনিয়োগ ও ব্যবসা করতে উঠেপড়ে লেগেছে, তারাও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়বে। তারা ভাববে মিয়ানমারের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করা ঠিক হবে না। ওই রায় সামনে রেখে তারাও মিয়ানমারকে চাপ দিতে পারে।
মিয়ানমারের নির্বাসিত সরকারের কর্মকাণ্ডকেও গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত। বিশেষ করে তারা ‘রোহিঙ্গা’ শব্দ ব্যবহার করেছে। রোহিঙ্গাদের রোহিঙ্গা বলে ডেকেছে। চিঠি দিয়েছে। গত ২০ বছরে মিয়ানমারের সব কটি আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের এখতিয়ার মেনে নেওয়ার ঘোষণাও নির্বাসিত সরকার দিয়েছে। এই সিদ্ধান্তগুলো তাৎপর্যপূর্ণ। তাদের এই সিদ্ধান্তগুলো কতটা কার্যকর হবে, সেই প্রশ্ন থাকারও পর এটা গুরুত্বপূর্ণ যে রোহিঙ্গাদের অধিকারের প্রশ্নে সে দেশের গণতান্ত্রিক শক্তি কথা বলেছে। তাই বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা তরুণদের মিয়ানমারের নির্বাসিত সরকারে যোগ দেওয়া উচিত। এর পাশাপাশি বাংলাদেশের যদি সুযোগ থাকে মিয়ানমারের নির্বাসিত সরকারের সঙ্গে কথা বলতে কোনো ক্ষতি নেই। বিশেষ করে তাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন না থেকে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার সুফল পাওয়া যেতে পারে।
রোহিঙ্গা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান হবেই—এমন নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। যে বিপুলসংখ্যক তরুণ শিবিরগুলোতে বড় হচ্ছে, সামনে কোনো আশা না থাকায় তারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে অশান্তির ছায়া আমাদের ওপর যাতে না পড়ে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। কারণ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মুখে আশ্বাস দেওয়া ছাড়া কাজের কাজ আর কিছুই করেনি।