কে শোনে মেঘনাপাড়ের মানুষের কান্না
মেঘনা উপকূলে নদীর জোয়ারের পানি ওঠা ছবি তুলতে আমি প্রায়ই নদীপাড়ে যাই। যেখানে বেড়িবাঁধ নেই, সেখানে জোয়ারের পানি ওঠা, বাড়িঘর পানিতে তলিয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিকের কিছু নয়। মানুষের নিত্যদিনের স্বাভাবিক ঘটনা বটে। বলছিলাম, লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও কমলনগরের মেঘনাতীরের কথা।
বাড়িরপাশের একটা খাল আছে। প্রতিদিনের জোয়ারের পানি পর্যবেক্ষণে থাকে আমার। ৪ আগস্ট বিকেলে যখন নদীতে জোয়ার হয়েছে, মেঘনা নদীর ১ ফুট উচ্চতার জোয়ার খেয়াল করেছি। পরদিন বিকেলে নদীতীর থেকে একজন বলল, ভাই, আজ জোয়ার হবে। আসবেন নদীপাড়ে? অপ্রস্তুত এই আমি বসে রইলাম না। মুঠোফোনে মাত্র ২০ শতাংশ চার্জ নিয়েও আমি চললাম। বিদ্যুৎ নেই, আসেও না, যাবে কোত্থেকে?
নদীপাড়ে যাব ভাবছি একটা উদ্দেশ্যে। সেটা হলো, জোয়ার হবে, ওটা নতুন এলাকা। আগে আর ওখানে জোয়ারের পানির ছবি তুলতে যাইনি। মেঘনার পাড় থেকে যখন আমি আধা কিলোমিটার আগের পথে পা দিই, তখন দেখি, একটা বাড়ির বাগান হয়ে একটা পুকুরে জোয়ারের পানি ঢুকছে। আমি সামনে এগিয়ে গেলাম। এক মিনিট পরে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, সব ভেসে গেছে। মুহূর্তেই হাঁটুপানি। দৌড়ে গিয়ে এক ছোট ভাইকে বললাম, তোমার ফোনটা দাও। পরিস্থিতি বেশ ভালো দেখছি না। দ্রুতই ওর ফোনটা নিয়ে আমি চললাম। আধা কিলোমিটার আগ থেকেই লোকজন আমাকে ‘না’ করছে, সামনে যাবেন না। যেতে পারবেন না, বিপদ। কিন্তু আমার মন মানছে না। তীরে যেন কিছু একটা হচ্ছে। যেখানে স্বাভাবিক জোয়ারের ছবি তুলতে যাব, সেখানে যে দেখছি, মুহূর্তেই সব ভেসে গেছে৷
আমরা সামনে এগোতে পারি না। পদে পদে বাধা। জোয়ারের পানিতে রাস্তার ওপর বিশাল একটা বাঁধা সৃষ্টি করেছে বনজঙ্গল। সেগুলোকে ডিঙিয়েই আমি চলছি। চারপাশে চোখ মেলে দেখি, মানুষের বাড়িঘর জলোচ্ছ্বাসের পানিতে ভেসে গেছে। একটা মাঝারি জলোচ্ছ্বাস। ৭ ফুট উচ্চতার। এমন জলোচ্ছ্বাস গত ২০ বছরেও নাকি দেখেননি ৮০ বছরের বয়স্ক লোকজন৷ গরু, ছাগল, মহিষ, হাঁস, মুরগি নিয়ে মানুষ পড়েছে মহাবিপদে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ৭ ফুট উঁচুতে পানি। সব ভেসে যাচ্ছে জলোচ্ছ্বাসে। স্রোতের তোড়ে কিছুই থাকছে না।
অবুঝ শিশু তার প্রিয় ছাগলটি বুকে জড়িয়ে ধরে রাখছে, কুকুরটি পানি ভেসে ছুটছে আশ্রয়ের খোঁজে, গরু-ছাগল ডুবছে জোয়ারে। কী যে একটা ভয়াবহ পরিস্থিতি। নদীপাড়ে এগোতেই দেখি, নদীতীরে যে দোকানঘরগুলো জলোচ্ছ্বাসের প্রবল ঢেউয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। চূর্ণবিচূর্ণ দোকানপাট ভেসে যাচ্ছে স্রোতের তোড়ে। একটি মসজিদঘরের ভেতর দিয়ে জোয়ারের পানি প্রবল ঢেউয়ে বইছে। লোকজন কান্না করছে, জলোচ্ছ্বাসে ডুবছে। সবকিছুই আমার ক্যামেরায় রেকর্ড হচ্ছে। রেকর্ড করছি, দাঁড়াতে পারছি না স্রোতের বিপরীতে। তখন আমার বুকে জলোচ্ছ্বাসের ঢেউ এসে ধাক্কা দেয়।
আমার তো ড্রোন নেই। একটু ওপর থেকে ছবি তোলা দরকার। সমুদ্রগামী কয়েকটা ট্রলার ভিড়েছে। ট্রলারে উঠে বেশ কয়েকটা ছবি তুলেছি। যেখানে দেখা যাচ্ছে, লোকজন জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁচতে অন্যত্র ছুটছে, জানমাল, দুটি নিয়েই। দেখে মনে হবে কয়েক তলাবিশিষ্ট ভবন থেকে ছবিগুলো তোলা হয়েছে। জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে ট্রলারগুলোও এলোমেলো হয়ে যায়। আমি আটকে থাকি ১৫ মিনিট। শেষমেশ এত বড় উঁচু ট্রলার থেকে লাফ দিয়ে পানি হয়ে নেমে যাই রাস্তায়। তারপর আরও কিছু দৃশ্য ধারণ করি সন্ধ্যা নাগাদ। বরাবর চারটা ঘণ্টা জলোচ্ছ্বাসের স্রোতের সঙ্গে যুদ্ধ করেছি। বিদ্যুৎ–সংযোগ পেতে পেতে রাতের ১১টা বেজে যায়। ভিডিওটি শেয়ার হতেই এখন পর্যন্ত (রোববার পর্যন্ত) ৬ লাখ প্লাস ভিউয়ারস।
সরেজমিন অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, বেড়িবাঁধ ভেঙে বা বেড়িবাঁধের ওপর দিয়ে জোয়ারের পানি লোকালয়ে ঢুকছে, মানুষের জীবনকে করে তুলেছে বিপর্যস্ত। লক্ষ্মীপুরের রামগতি, কমলনগর, সদর, রায়পুরের মেঘনাতীরের কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। কোনো কোনো এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, জোয়ারের পানি ঢুকতে পারছে কিন্তু যেতে পারছে না। এতে পানিবন্দী মানুষ জীবন নিয়ে বেশ শঙ্কায় পড়েছে। জোয়ারের পানিতে ডুবে গেছে মানুষের কোটি কোটি টাকার মাছ৷ প্রজেক্টের মাছ ছাড়াও বাড়ির ব্যক্তিগত পুকুরের মাছও গেছে বানের জলে। হাঁস-মুরগি হারিয়ে গৃহিণীরা সেসবের খোঁজে ছুটছেন এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি।
চুলো ডুবে গেছে, যাবতীয় রান্নাবান্নার কাজ, সবই বন্ধ। উপবাসে দিন কাটছে হাজারো মানুষের। কিন্তু এ মুহূর্তে জলোচ্ছ্বাসের ৭ দিন চললেও জলোচ্ছ্বাসে ভাসা মানুষের কাছে পৌঁছেনি সরকারের সহায়তা। দু–একটি সামাজিক সংগঠন এগিয়ে এলেও দায়সারাভাবে নদীতীর ঘুরে চলে গেছেন জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের লোকজন। ওদিকে এখনো সর্বত্র হাহাকার। সবাই বলছে, আমরা সরকারের সহযোগিতা চাই, আমরা বেড়িবাঁধ চাই। কিন্তু কে শোনে মেঘনাপাড়ের মানুষের কান্না?