কৃত্রিম প্রজননে কোরালের পোনা
সুস্বাদু কোরাল কিংবা ভেটকি মাছের কদর দেশব্যাপী। বঙ্গোপসাগরের গভীর জলের মাছ কোরাল সব সময় হাটবাজারে পাওয়া যায় না। চিংড়ির মতো চাষের মাধ্যমে কোরাল মাছ উৎপাদনের তেমন সুযোগও নেই। কিন্তু এখন যে কেউ চাইলে কোরাল মাছের চাষে হাত বাড়াতে পারেন। কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে কক্সবাজারে উৎপাদিত হচ্ছে কোরাল মাছের পোনা।
বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে কোরাল মাছের পোনা উৎপাদনে সফল হয়েছেন দেশের মৎস্য বিজ্ঞানীরা। সেই সঙ্গে তাঁরা বঙ্গোপসাগরের ‘কক্সবাজার-সোনাদিয়া’ উপকূলের ২৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কোরাল মাছের প্রজননক্ষেত্র চিহ্নিত করেছেন। গত এক বছর বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের চালানো এক গবেষণায় এ সাফল্য এসেছে।
তবে এটি প্রাথমিক সাফল্য মনে করেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ও দেশের বিশিষ্ট মৎস্য বিজ্ঞানী ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ।
তিনি বলেন, ২০১৮ সালের এপ্রিল মাস থেকে শুরু হওয়া এক গবেষণায় প্রথমবারের মতো হ্যাচারিতে কৃত্রিম উপায়ে কোরাল মাছের পোনা উৎপাদনে সাফল্য এসেছে। তবে এ জন্য আরও গবেষণা দরকার। কোরালের বাণিজ্যিক চাষ শুরু হলে দেশের অর্থনীতি তথা সামুদ্রিক মৎস্য ক্ষেত্রে এক বিপ্লবের সূচনা হবে।
মৎস্য বিজ্ঞানীরা বলেন, এর আগে গবেষণার মাধ্যমেই কক্সবাজারে প্রথমবারের মতো কাঁকড়া পোনা উৎপাদনে সাফল্য পান মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। এখন আর দেশে কাঁকড়া পোনার সংকট নেই। এখন কোরালের পাশাপাশি অন্যান্য মূল্যবান ও অর্থকরী মাছেরও কৃত্রিম পোনা উৎপাদনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সূত্রমতে, ‘সামুদ্রিক মৎস্য গবেষণা জোরদারকরণ ও অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থায়নে ‘ভেটকির মা মাছ তৈরি ও কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন গবেষণা’ শীর্ষক একটি প্রকল্প পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের কক্সবাজারের সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুল হকের নেতৃত্বে এ গবেষণা কাজ পরিচালিত হচ্ছে। এক বছরের বেশি সময় ধরে গবেষণা চালানোর পর গত মে মাসে সর্বপ্রথম ভেটকি মাছের কৃত্রিম প্রজননে সাফল্য পাওয়া যায়। আর গবেষণা চালাতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো বঙ্গোপসাগরে চিহ্নিত করতে সক্ষম হন কক্সবাজারের কলাতলী থেকে সোনাদিয়া পর্যন্ত ২৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কোরাল মাছের প্রজনন ক্ষেত্র।
মৎস্য কর্মকর্তা বলছেন, উপকূলীয় এলাকার অতিপরিচিত সুস্বাদু মাছ কোরাল। এ মাছ কম কাটাযুক্ত, দ্রুত বর্ধনশীল ও খেতে সুস্বাদু বলে এর বাজারমূল্য বেশি। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এ মাছের ব্যাপক চাহিদা ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ প্রতিবেশী দেশগুলো আগেই হ্যাচারিতে কৃত্রিম উপায়ে কোরাল পোনা উৎপাদনে সক্ষম হলেও বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা এত দিন ছিলেন পিছিয়ে।
তবে দীর্ঘদিন ধরে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাটসহ দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ঘেরের মধ্যে চিংড়ির সঙ্গে কোরাল মাছেরও কিছুটা চাষ হচ্ছে। কোরাল মাছ লবণাক্ত, আধা-লবণাক্ত, এমনকি স্বাদু পানিতেও চাষ করা যায়। এ মাছের রোগবালাই কম বলে সাম্প্রতিককালে অনেকেই চিংড়ি চাষ বাদ দিয়ে কোরাল চাষে নেমেছেন। তবে পোনার সংকটের কারণে অনেকে লাভজনক কোরাল চাষে নামতে পারছেন না। প্রজননের মাধ্যমে কোরাল মাছের পোনা বাজারে সরবরাহ হলে এই মাছ চাষে বিপ্লব শুরু হবে।
কক্সবাজারের সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুল হক বলেন, একটি পরিপক্ব স্ত্রী কোরাল মাছ ৬০ লাখ থেকে ২ কোটি পর্যন্ত ডিম দিতে সক্ষম। ফলে হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদনের জন্য স্বল্পসংখ্যক মা কোরালই যথেষ্ট। তবে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মা কোরাল তৈরি হওয়ার জন্য যে ৪-৫ বছর সময়টুকু দরকার, তা রক্ষা করতে হবে।
মোহাম্মদ আশরাফুল হক বলেন, কোরাল মাছ প্রথমে পুরুষ হয়ে জন্মায় এবং ৪-৫ বছর পর কিছু স্ত্রীতে রূপান্তরিত হয়। রূপান্তরিত হওয়ার পরই প্রজননের জন্য উপকূলের নদী মোহনার কাছে চলে আসে। কোরাল মাছের প্রজননকাল এপ্রিল থেকে শুরু হলেও সবচেয়ে বেশি ডিম দেয় মে মাসে। গত ২৩ মে সোনাদিয়া উপকূলে গবেষণা চালানোর সময় বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুল হক কোরাল মাছের ডিম পাড়ার দৃশ্য স্বচক্ষে দেখেন এবং ওখান থেকে সংগৃহীত মা মাছটি হ্যাচারিতে এনে কৃত্রিম উপায়ে তিনি পোনা উৎপাদনে সক্ষম হয়েছেন।