বিআরটি প্রকল্প
কাজে ধীরগতি, ব্যয় বেড়ে দ্বিগুণ
বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বাসের আলাদা লেন তৈরির পাঁচ বছরের প্রকল্পে আট বছর পার, অগ্রগতি ৪০%। দুর্ভোগের শেষ নেই।
রাজধানীর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত দ্রুত বাস চলাচলের জন্য নেওয়া ঢাকা বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প ধীরগতির নজির তৈরি করেছে। যে পথে প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তা বাদ দিয়ে নতুন পথ নির্ধারণ, প্রকল্প নেওয়ার আগে চূড়ান্ত সমীক্ষা না করা, বারবার নকশায় বদল ও নতুন নতুন অবকাঠামো যোগ—এসব করতে গিয়ে কাজ তেমন একটা এগোয়নি।
সব মিলিয়ে পাঁচ বছরের প্রকল্পে আট বছর পেরিয়েছে। কিন্তু কাজের অগ্রগতি মাত্র ৪০ শতাংশের মতো। ব্যয় বেড়েছে ১০৯ শতাংশ, যা টাকার অঙ্কে ২ হাজার ২২৫ কোটি টাকা।
এ বিলম্ব ও ব্যয় বৃদ্ধিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের কোনো জবাবদিহি করতে হয়নি। বাড়তি ব্যয়ের টাকা দেশের মানুষকেই দিতে হবে। আর নির্মাণকাজে বিলম্বের কারণে তাঁদেরই ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকতে হয়। কারণ হলো, বিআরটির নির্মাণকাজের জন্য বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত সড়ক সরু হয়ে গেছে। রাস্তাঘাটও ভাঙাচোরা।
বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত ঘুরে গতকাল সোমবার দেখা যায়, সড়কটির আবদুল্লাহপুর মোড় থেকে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার সড়ক খানাখন্দে ভরা। অবস্থা বেশি খারাপ টঙ্গী বাজার থেকে চেরাগ আলী পর্যন্ত। যদিও গত ১৯ জুন প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে সেতু বিভাগের সচিব আবু বকর সিদ্দিক তিন দিনের মধ্যে খানাখন্দ মেরামতের কথা বলেছিলেন। এরপর কোনোরকমে মেরামত হয়েছিল। এখন আবার খানাখন্দ তৈরি হয়েছে।
একটি বেসরকারি হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স চালক মো. জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সড়কে গর্তের কারণে ঝাঁকুনিতে রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। স্বজনেরা বকাঝকা করেন। মুখ বুজে সহ্য করতে হয়।
ঢাকার জন্য ২০০৫ সালে করা ২০ বছরের পরিবহন পরিকল্পনার (এসটিপি) আওতায় বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার সড়কে বাসের আলাদা লেন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এটাই বিআরটি প্রকল্প, যা ২০১২ সালের ১ ডিসেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন পায়। ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৪০ কোটি টাকা। প্রকল্পটিতে অর্থায়ন করছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ফরাসি উন্নয়ন সংস্থা এএফডি, গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি নামের একটি সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকার।
২০১৬ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শেষ করে বাস বিআরটিতে নামানোর কথা ছিল। সরকার এখন বিআরটি প্রকল্পের অবকাঠামো নির্মাণকাজ শেষ করার সময় নির্ধারণ করেছে ২০২২ সাল। নতুন করে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, ব্যয় বৃদ্ধির মূল কারণ সময়মতো কাজ শেষ না হওয়া। দেরি হওয়ায় নির্মাণ উপকরণের দাম বাড়ার কারণে ৭২৩ কোটি টাকা ব্যয় বেড়েছে। পরামর্শকদের বাড়তি সময়ের বেতন-ভাতাও যোগ হয়েছে। এর বাইরে কিছু কাজ যোগ করা এবং বাড়তি জমি অধিগ্রহণও ব্যয় বৃদ্ধির জন্য দায়ী। বাড়তি ব্যয়ের টাকার সংস্থান এখনো হয়নি। অর্থ পেতে উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে দেনদরবার চলছে।
বিআরটি প্রকল্পের মূল অবকাঠামো নির্মাণের কাজ করছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)। সংস্থাটি এ প্রকল্পে পরিচালক বদলেছে মোট ছয়বার। নির্মাণকাজে বিলম্বের কারণ নিয়ে প্রকল্পের
বর্তমান পরিচালক সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এ এস এম ইলিয়াস শাহ প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পটি ব্যস্ত সড়কে হওয়ায় কাজের গতি কম। এ ছাড়া জমি অধিগ্রহণসহ আরও কিছুটা জটিলতা ছিল।
শুরুর গাফিলতিতে পদে পদে সমস্যা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি বড় প্রকল্প নিতে শুরুতে প্রাথমিক সমীক্ষা করতে হয়। এরপর চূড়ান্ত সমীক্ষা করে প্রকল্পের কাজ শুরু করতে হয়। কাজটি করা হলে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সমস্যাগুলো আগেই ধরা পড়ে। তখন বারবার পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে হয় না।
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গাজীপুর-বিমানবন্দর অংশে বিআরটি নির্মাণে ২০১১ সালে প্রাথমিক সমীক্ষা করে এডিবি। তবে পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা ও নকশা হওয়ার আগেই প্রকল্প নেওয়া হয়। বাস্তবায়ন করতে গিয়ে নানা সমস্যা তৈরি হয়। যেমন নির্মাণকাজ করতে গিয়ে দেখা যায়, প্রকল্প এলাকায় যথাযথ পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা নেই। ফলে পানি জমে যাচ্ছে। সেবা সংস্থার লাইন কীভাবে সরানো হবে, তা-ও আগে থেকে ঠিক করা হয়নি। ব্যস্ততম সড়কে নির্মাণকাজের সময় যান চলাচল স্বাভাবিক রাখার কোনো বিকল্প চিন্তাও করা হয়নি।
প্রকল্প সূত্র জানায়, বিআরটি প্রকল্পে প্রথমে উড়ালসড়কের পথ বক্স গার্ডার ধরে নকশা করা হয়। কিন্তু নির্মাণকাজ শুরুর দুই বছর পর ঠিকাদারের চাপে তা পরিবর্তন করে ‘আই’ গার্ডার করা হয়। কারণ হিসেবে বলা হয়, বক্স গার্ডার হলে পর্যাপ্ত জায়গা পাওয়া যাবে না।
২০১৯ সালে এসে বিমানবন্দর এলাকায় মানুষের রাস্তা পারাপারের জন্য বিআরটির মধ্যে একটি পাতালপথ যুক্ত করা হয়। এর ফলে ব্যয় বাড়ে ৪২০ কোটি টাকা। সেখানকার জমি সওজ, রেলওয়ে ও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের। এর মধ্যে বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের জমি বেসরকারি খাতে ইজারা দেওয়া আছে। রেলওয়ে ও সওজ জমি দিতে চায় না। ফলে এ পাতালপথের কাজই অনিশ্চিত।
বিআরটির চার ধরনের কাজ বাস্তবায়নে নিয়োজিত সরকারের চারটি সংস্থা—সওজ, সেতু বিভাগ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) ও ঢাকা বিআরটি কোম্পানি। এর বাইরে কাজ তদারকিতে নিয়োজিত আছে চারটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। সওজের অধীনে ১৬ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়ন ও প্রশস্তকরণ, বিআরটি লেন নির্মাণ, ছয়টি ছোট উড়ালসড়ক, ২৫টি বিআরটি স্টেশন ও বিমানবন্দরের কাছে পথচারী পারাপারে পাতালপথ নির্মিত হচ্ছে। সাড়ে চার কিলোমিটার উড়ালপথ নির্মাণ, এর মধ্যে বিআরটি লেন তৈরি, স্টেশন নির্মাণ এবং বিদ্যমান টঙ্গী সেতুর জায়গায় ১০ লেনের একটি নতুন সেতু নির্মাণের দায়িত্বে রয়েছে সেতু বিভাগ। এলজিইডি তাদের ভাগের কাজ শেষ করেছে। তারা সহযোগী সড়ক ও গাজীপুরে একটি বাস ডিপো নির্মাণ করেছে। কেনা হয়েছে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রপাতি এবং সড়কবাতি, যা সৌরবিদ্যুতে চলবে। তবে প্রকল্প শেষ না হওয়ায় এসবের কিছুই কাজে লাগছে না।
এ তিন সংস্থার কাজের শেষ পর্যায়ে আসে বিশেষ বাস পরিচালনার বিষয়টি। এ দায়িত্বে আছে ঢাকা বিআরটি কোম্পানি। তাদের অধীনে বাস ক্রয়, বেসরকারি পরিবহনমালিকদের এ ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তি, আধুনিক পদ্ধতিতে বাস পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণ করার কথা। তবে আলাদা লেনে উন্নত মানের বাস কিনে চালানোর যে চিন্তা ছিল, তা আপাতত বাদ দিচ্ছে সরকার। ঢাকা বিআরটি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও কোম্পানি সেক্রেটারি নিয়োগ ছাড়া আর কিছুই হয়নি। কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, শুরুতে বিদ্যমান বাসগুলোকে শৃঙ্খলায় এনে চালানো হবে। পরে নতুন বাস কেনা হবে।
বিআরটির বাকি অংশ
বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর অংশ পর্যন্ত বাস্তবায়নের পাশাপাশি কেরানীগঞ্জ থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত আরেকটি রুটে বিআরটি প্রকল্প হওয়ার কথা। এ জন্য অর্থায়ন করার কথা বিশ্বব্যাংকের। এ জন্য ৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে বিস্তারিত সমীক্ষা ও নকশাও প্রণয়ন করা হয়েছিল। কিন্তু গত বছর সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিশ্বব্যাংককে জানিয়ে দেন, বিআরটি প্রকল্পের পরের ধাপ আর বাস্তবায়নের ইচ্ছা নেই সরকারের। কারণ, গাজীপুর-বিমানবন্দর অংশের নির্মাণকাজের জন্য জনদুর্ভোগ হচ্ছে, আর দুর্ভোগ বাড়াতে চায় না সরকার।
বিআরটি কেন জরুরি
জাপানের উন্নয়ন সহযোগিতা সংস্থা জাইকা ২০০৯ সালে বিআরটি নিয়ে একটি সমীক্ষা করে। এ সমীক্ষা অনুযায়ী, ঢাকার ৬৭ শতাংশ যাত্রী বাসে যাতায়াত করে। তবে যানজটের কারণে ঢাকায় যানবাহনের গতি নেমেছে ঘণ্টায় প্রায় পাঁচ কিলোমিটারে, যা অনেকটা হাঁটার গতির সমান। বাসে বিপুলসংখ্যক মানুষের দ্রুত চলাচল নিশ্চিত করতে বিআরটির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়েছিল। বিআরটি প্রকল্প প্রস্তাবে বলা আছে, বিআরটি চালু হলে দ্রুত, নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব বাস সেবার মাধ্যমে ঘণ্টায় ২০ হাজার যাত্রী পরিবহন করতে পারবে।
বিআরটির পরিকল্পনাটি এমন যে বিদ্যমান সড়কের মাঝখানের একটা অংশ আলাদা করে ফেলা হবে। এর মধ্যে হবে বাস আসা-যাওয়ার পথ। বিশেষ পথে অন্য যানবাহন প্রবেশের সুযোগ পাবে না। ফলে যানজট হবে না, নির্বিঘ্নে চলবে বাস।
‘প্রকল্পটি এখন বোঝা’
বিশেষজ্ঞ ও প্রকল্প কর্মকর্তারা বলছেন, বিআরটির মতো প্রকল্প বাস্তবায়নে বড়জোর দুই বছর লাগে। এর ব্যয়ও কম। কিন্তু বিমানবন্দর-গাজীপুর প্রকল্পে উড়ালসড়ক, পাতালপথ, সেতুসহ অন্যান্য কাজ যুক্ত করে এটি জটিল করা হয়েছে। বিমানবন্দর থেকে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত অংশ বাদ দেওয়ায় বিআরটির পরিপূর্ণ সুফল মিলবে না।
সার্বিক বিষয়ে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, স্বাভাবিক ব্যবস্থায় একটা বাস একই পরিমাণ সড়কে যত যাত্রী পরিবহন করতে পারে, বিআরটিতে তার ১০ গুণ বেশি হয়। কিন্তু পথ পরিবর্তন এবং এর মধ্যে উড়ালসড়ক, পাতালপথ যুক্ত করার কারণে বিআরটি প্রকল্প বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন সংবাদদাতা, গাজীপুর]