কর্নেল জামিল: অন্ধকারে অবিচল আত্মদান
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সামরিক সচিব কর্নেল জামিল উদ্দীনকে শেষবারের মতো কল দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু কর্নেল জামিলকে বলেছিলেন, তাঁকে আক্রমণ করা হয়েছে, ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি ঘেরাও করা হয়েছে। পরে লাইন কেটে যায়।
যে কালরাতে ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল, নগরীকে ঘিরে ধরেছিল অনিশ্চয়তা। দেশের নেতৃত্ব অচল হয়ে পড়েছিল। কিন্তু কর্নেল জামিল তাঁর দায়িত্ব থেকে সরে আসেননি। তিনি সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহসহ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের কল করেন এবং তাঁদের সেনা পাঠাতে বলেন। তিনি প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টকে বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার নির্দেশ দেন এবং তৎক্ষণাৎ ৩২ নম্বর রোডের বাড়ির দিকে ছুটে চলেন।
তার আগে শান্তভাবে নিজের পিস্তল খাপে রেখে স্ত্রী-সন্তানদের বলেন, বঙ্গবন্ধুর বিপদ। কীভাবে আমি না গিয়ে পারি! জিপে চড়ার আগে স্ত্রীর প্রতি তাঁর শেষ কথা ছিল, আমার কন্যাদের খেয়াল রেখো। অন্ধকার ভেদ করে গাড়ি চলে যায় ৩২ নম্বর রোডের বাড়ির দিকে।
সোবহানবাগ মসজিদের কাছে পৌঁছালে পিজিআর কনভয় কর্নেল জামিলকে থামায়। তিনি কারণ জানতে চান। তাঁকে বলা হয়, সামনে সেনা ইউনিট রয়েছে এবং গোলাগুলি চলছে। তিনি সেনাদের সামনে এগোনোর জন্য বোঝাতে চেষ্টা করেন। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে তিনি জিপে চেপে বসেন এবং নিজে গাড়ি চালিয়ে ৩২ নম্বর রোডে যাওয়ার চেষ্টা করেন।
গুলি করা হয় কর্নেল জামিলকে। গাড়ির ভেতর লুটিয়ে পড়েন তিনি। শাহাদতবরণ করেন কর্নেল জামিল, যিনি অন্যদের মতো বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার শপথ নিয়েছিলেন। নীতি ও কর্তব্যের প্রতি অবিচল আনুগত্য কর্নেল জামিলকে দান করেছে শহীদের মর্যাদা। যে রাতে অনেক সাহসী মানুষ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগেছেন, সে রাতে কর্নেল জামিল একচুলও টলেননি তাঁর কর্তব্যবোধ থেকে। সাহসিকতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন কর্নেল জামিল। জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন কর্তব্যবোধকে।
১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট বেলা প্রায় দুইটা পর্যন্ত জামিলের পরিবার জানত না কী ঘটেছিল তাঁর ভাগ্যে। ফোন করলেন জেনারেল সফিউল্লাহকে, যাঁকে ভোরে কর্নেল জামিল বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে সেনা পাঠাতে অনুরোধ করেছিলেন। ফোন ধরলেন মিসেস জামিল। স্বামীর মৃত্যুসংবাদ মিসেস জামিলকে দিতে গলা ধরে আসছিল জেনারেল সফিউল্লাহর। চলে গেলেন বাংলাদেশের এক খাঁটি দেশপ্রেমিক।
কর্নেল জামিল অসাধারণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় কর্নেল জামিল পাকিস্তানে জিম্মি অবস্থায় ছিলেন। একজন সেনা কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর আন্তরিকতা এবং পেশাদারত্বে মুগ্ধ হয়ে স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু তাঁকে তাঁর সামরিক সচিব নিযুক্ত করেছিলেন।
কর্নেল জামিল ও কে এম সফিউল্লাহ একসঙ্গে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নেন। অনেক বছর পর বন্ধুর স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে কে এম সফিউল্লাহ বলেন, ‘সেই দিনগুলোতে জামিল ভাই, আমি এবং কিছু বাঙালি অফিসার পাকিস্তানে ছিলাম এবং আমাদের মাঝে নিয়মিত যোগাযোগ হতো। সে সময় বাঙালি জাতীয়বাদ ছিল উদীয়মান অবস্থায়। পাকিস্তানের অধিকাংশ জনসংখ্যা বাংলাদেশের হওয়া সত্ত্বেও আমরা দেখেছি সেনাবাহিনীতে আমাদের প্রতিনিধিত্ব কত কম ছিল। যখনই আমাদের সাক্ষাৎ হতো আমরা এ বিষয়ে কথা বলতাম। আমাদের মধ্যে জামিল ভাইয়ের জাতীয়তাবোধ ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী এবং মাঝে মাঝে তিনি ক্রোধে বেপরোয়া হয়ে যেতেন।’
২০১০ সালে কর্নেল জামিলকে মরণোত্তর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদবি দেওয়া হয় এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সেই সকালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাঁচানোর জন্য যে অসীম সাহসিকতা দেখিয়েছিলেন, তার স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে বীর উত্তম উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
আমাদের দেশে রাজনৈতিক মেরুকরণের কারণে অনেক দেরিতে এ সম্মান দেওয়া হয় কর্নেল জামিলকে। কারণ, এ দেশে স্বজনপ্রীতির দর্পণে দেখা হয় ত্যাগ ও সাহসিকতাকে। আমাদের জাতির জন্য কর্নেল জামিলকে স্মরণের এ এক বিলম্বিত ক্ষণ। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ মহান বীরের বিরল আত্মত্যাগের ওপর আরও নিবিড় নজরপাতের সময় এসেছে।
কর্নেল জামিলের জ্যেষ্ঠ কন্যা তাহমিনা এনায়েত বলেন, ‘তাঁর আত্মা শান্তিতে থাকবে এবং আমিও মরে যাব। আমার বাবা ছিলেন এক সৎ কর্মকর্তা। আমি গর্বিত, আমার বাবা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর মতো নেতার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন।’
জামিলের অমর আত্মদান বাঁচিয়ে রেখেছে তাঁকে আমাদের মাঝে। দেশের ডাকে তিনি সাড়া দিয়েছেন এবং কর্তব্য পালনের জন্য হাসিমুখে জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। জাতি যখন দাঁড়িয়ে ছিল অনিশ্চয়তার বাঁকে, জামিল দেখিয়েছেন অনুপম নৈতিক সাহসিকতা, যা তাঁকে করেছে মহান এবং সত্যিকারের নায়ক।
এনায়েতউল্লাহ খান: এডিটর ইন চিফ, ইউনাইটেড নিউজ অব বাংলাদেশ (ইউএনবি) এবং ঢাকা কুরিয়ার।