করোনায় স্বপ্নভঙ্গ তাদের

প্রতীকী ছবি

‘কলেজে পড়ার খুব ইচ্ছা ছিল। তা আর হলো কই। করোনার কারণে স্কুল বন্ধ ছিল দীর্ঘদিন। এর মধ্যে বাবার আয়রোজগারও কমে যায়। তাই পরিবার থেকে বিয়ে দিয়ে দিল। আসলে রাজি না হয়ে উপায় ছিল না। আর বউ পড়াশোনা করুক, তা শ্বশুরবাড়ির লোকজন চান না। তাই আমার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে।’

মন খারাপের এমন কথা আফসানা বেগমের (ছদ্মনাম)। চট্টগ্রামের হাটহাজারীর ফতেয়াবাদ বহুমুখী সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের এই ছাত্রীর এবার এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই গত জানুয়ারিতে বিয়ে দেয় পরিবার। এখন শ্বশুরবাড়িতে আছে সে। যোগাযোগ করা হলে আফসানা জানায়, করোনার বন্ধে তার ক্লাসের আরও পাঁচজনের বিয়ে হয়ে গেছে। আর এই বিদ্যালয়ের মোট ১০ জন ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে বলে শিক্ষকেরা জানান।

এই বিদ্যালয়ের শ্রেণিশিক্ষক শিল্পী চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেয়েগুলো যাতে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারে, সে জন্য পরিবারের সঙ্গে অনেকবার যোগাযোগ করেছি। কিন্তু ইতিবাচক সাড়া পাইনি।’

শুধু আফসানা নয়, চট্টগ্রাম নগর ও গ্রামের অনেক স্কুলছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে করোনা মহামারির সময় (গত বছরের মার্চ থেকে চলতি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত)। দীর্ঘদিন পর বিদ্যালয় খুললেও বিয়ে হয়ে যাওয়া ছাত্রীদের অধিকাংশ এখন আর স্কুলে আসছে না। যখন পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা, তখন তাদের ঘর–সংসারের কাজে মনোযোগ দিতে হচ্ছে।

চট্টগ্রামে হওয়া বাল্যবিবাহের সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান সরকারি বা বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে নেই। তবে প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা চট্টগ্রাম নগর ও উপজেলার ২০টি বিদ্যালয়ে গিয়ে জেনেছেন, এসব বিদ্যালয়ের অন্তত ২১৩ ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, শ্রেণিশিক্ষক, বাল্যবিবাহের শিকার ছাত্রী ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

চট্টগ্রাম জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম জিয়াউল হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, করোনার সময় ঠিক কী পরিমাণ বাল্যবিবাহ হয়েছে, তার কোনো তথ্য-উপাত্ত তাঁর কাছে নেই। তবে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু জায়গায় ছাত্রীদের বিয়ে হওয়ার কথা শুনেছেন।
অভিভাবক ও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কাজ করা এনজিও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনা মহামারির সময় অনেক ছাত্রছাত্রীর অভিভাবক চাকরি হারিয়েছেন। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আয়রোজগারও ছিল না। আর্থিক অনটনের কারণে অনেকেই শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন। অনেক জায়গায় মেয়েদের সামাজিক নিরাপত্তাও ভঙ্গুর। বখাটেদের উৎপাত রয়েছে। আবার অনেকেই সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। মূলত এসব কারণে বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটেছে।

মানবাধিকার সংগঠন ইলমার প্রধান নির্বাহী জেসমিন সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, করোনার কারণে গ্রামে ও নগরে বাল্যবিবাহের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। মহামারির সময় বাল্যবিবাহবিরোধী যে রকম প্রচার-প্রচারণা ও সচেতনতামূলক কর্মসূচির দরকার ছিল, তা আসলে করা সম্ভব হয়নি।

সরেজমিন ঘুরে দেখা বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে চট্টগ্রাম নগরের ২টি বিদ্যালয়ের ১৫ ছাত্রী, মিরসরাইয়ের ৫টি বিদ্যালয়ের ৫১ ছাত্রী, সীতাকুণ্ডের ৩ বিদ্যালয়ের ৩৯ ছাত্রী, রাঙ্গুনিয়ার ১ বিদ্যালয়ের ১৬ ছাত্রী, সাতকানিয়ার ২টি বিদ্যালয়ের ১২ ছাত্রী, আনোয়ারার ৩টি বিদ্যালয়ের ১২ ছাত্রী, রাউজানের ৩টি বিদ্যালয়ের ১৬ ছাত্রী, সন্দ্বীপের ২টি বিদ্যালয়ের ২৮ ছাত্রী ও পটিয়ার ২টি বিদ্যালয়ের ২৪ ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে।

অভিভাবকদের দাবি, মেয়ের বয়স ১৮ হওয়ার পর বিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু প্রধান শিক্ষকেরা বলেন, ভুয়া জন্মনিবন্ধন দিয়ে কাবিননামা তৈরি করেছেন।

চট্টগ্রাম নগরের একটি উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রী রেহেনা খানমের (ছদ্মনাম) গল্প অন্য রকম। পরিবারের আর্থিক অবস্থা তেমন খারাপ নয়। তারপরও নবম শ্রেণির এই ছাত্রীর বিয়ে দিয়েছে পরিবার। যোগাযোগ করা হলে ওই ছাত্রীর মা মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আল্লাহর হুকুম ছিল। ছেলেও ভালো পেয়েছি। আত্মীয়স্বজনেরাও ধরেছিল। তাই মেয়ের বিয়ে দিয়ে ফেলেছি। মেয়ে এখন শ্বশুরবাড়িতে আছে।’

চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের আবুল কাশেম বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর ভাবি জানান, মেয়ের বাবা নেই। খালাদের চাপে বিয়ে দিতে হয়েছে।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের হামিদুল্লা হাট উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রবীর নাথ প্রথম আলোকে বলেন, অভাবের কারণে মেয়ে বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন বলে দাবি অভিভাবকদের। একই কথা চট্টগ্রামের দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপের মোমেনা সেকান্দর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. তৈয়বের।

নিরাপত্তা ও প্রেমঘটিত কারণে মেয়ের বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন বলে জানান রাঙ্গুনিয়া ও বাঁশখালীর দুই ছাত্রীর বাবা।

প্রশাসনের কর্মকর্তা ও শিক্ষকেরা জানান, করোনার বন্ধের সময় বিদ্যালয়ের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের যোগাযোগও বন্ধ হয়ে যায়। আবার অনেক পরিবার গ্রামে চলে যায়। এই সুযোগে পরিবারগুলো গোপনেই তাদের মেয়েদের বিয়ে দিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে তা জানা সম্ভব হয়নি। যখনই জানা গেছে, তখনই অভিযান পরিচালনা করে বাল্যবিবাহ বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অনেক জায়গায় বাল্যবিবাহের শিকার হতে যাওয়া ছাত্রীরা নিজেরাই ফোন করে বিয়ে ঠেকিয়েছে।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন গত এক বছর নগর এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১৬টি বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছে। এসব ঘটনায় অভিভাবকদের জরিমানাও করা হয়েছে। কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল তিনজনকে।

অভিযান পরিচালনার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, নগরের রাহাত্তারপুল এলাকায় ১৩ বছর বয়সী মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিল পরিবার। খবর পেয়ে তা বন্ধ করেন তিনি। মেয়ের বয়স ১৮ হলে যাতে বিয়ে করেন, সে জন্য বরপক্ষের কাছ থেকে মুচলেকা নিয়ে রেখেছেন। মূলত মেয়ের নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কায় ছিলেন মা-বাবা। এ জন্য বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তাঁরা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক আলা উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, করোনার কারণে নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। আবার বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় মেয়েরা টানা ঘরে ছিল। ফলে তাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ থাকে অভিভাবকদের। মেয়েদের বিয়ে দেওয়াকেই এসব থেকে মুক্তির আপাতত সমাধান হিসেবে বেছে নেন অভিভাবকেরা। কিন্তু বাল্যবিবাহের শিকার এসব ছাত্রী বিয়ের জন্য প্রস্তুত ছিল না। ফলে পরবর্তী সময়ে গর্ভধারণসহ নানা কারণে তারা মানসিক ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতে থাকবে।


(তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন উপজেলা প্রতিনিধিরা)