করোনায় ভয় পেলে আপনার হবে ক্ষতি
জ্যামিতিক হারে বাড়ছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যু। এর মধ্যে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে মারা গেছেন ১৩ হাজার ৪৯ জন। বাংলাদেশেও মারা গেছেন দুজন। সংক্রমিত ২৭ জন।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত সব গণমাধ্যম প্রতিমুহূর্তে করোনাভাইরাসের খবর প্রকাশ করে যাচ্ছে। ফেসবুকসহ শীর্ষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও করোনাভাইরাসের খবরে আগ্রহ মানুষের। অর্থাৎ, এই সময়ে করোনাভাইরাস মানুষের চিন্তার প্রধান বিষয়।
আরাফাত হোসেন ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তাঁর দুই ছেলে, এক মেয়ে। বড় ছেলে নবম শ্রেণিতে, ছোটটি পঞ্চম শ্রেণিতে। মেয়েটির বয়স মাত্র তিন বছর। স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাঁরা ঘরে বন্দী। কিন্তু চাকরির কারণেই আরাফাতকে রোজ বাসা থেকে বের হতে হচ্ছে।
আরাফাত বেশ চিন্তিত। তবে করোনাভাইরাসের থেকে বাঁচার জন্য নিয়ম মেনে মাস্ক পরছেন। নিয়মিত সাবান দিয়ে হাত ধুচ্ছেন।
আরাফাত বলেন, ‘যেভাবে মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে, এই খবরে আমি খুব চিন্তিত। ভয় পাচ্ছি, আমিও যদি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে যাই। আমার বাচ্চারাও যদি করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়।’
একপর্যায়ে আরাফাত বললেন, ‘ভাই, আমি কিছু ভাবতে পারছি না। করোনাভাইরাস নিয়ে একটা অজানা ভয় আমার মধ্যে কাজ করছে।’
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস নিয়ে এমন ভয় বা আতঙ্ক অনেকের মধ্যে রয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে এই ভয় বা আশঙ্কা অস্বাভাবিক কিছু নয় বলে মনে করেন মনোরোগ চিকিৎসক আহমেদ হেলাল। তিনি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।
আহমেদ হেলাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা বলছে, করোনাভাইরাস নিয়ে সৃষ্ট বৈশ্বিক মহামারির এই সময়ে আতঙ্কিত হওয়া, ভয় পাওয়া, অবসাদে ভোগা, রেগে যাওয়া, হতাশ হয়ে যাওয়া, এগুলো স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। মানুষ আতঙ্কিত হবে। ভয় পাবে। উদ্বিগ্ন হবে। তাদের আচরণের পরিবর্তন অবশ্যই হবে।’
তাহলে করোনাভাইরাস নিয়ে এই ভয়, আতঙ্ক, এমন পরিস্থিতিতে মানুষ কী করবে?
আহমেদ হেলাল বলেন, ‘আমরা যদি আতঙ্কিত হই, আমরা যদি মানসিক চাপে ভুগতে থাকি, আমরা যদি ভয় পাই, উদ্বিগ্ন হই, তাহলে আমাদের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা কমতে থাকবে। আতঙ্কিত বা ভয় পেলে আমাদের শরীরের বিভিন্ন ট্রান্সমিটারে একটা তারতম্য ঘটে। এতে স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা কমে যায়। ফলে যিনি আতঙ্কিত হবেন, উদ্বিগ্ন হবেন, যার মধ্যে মানসিক চাপ বেশি থাকবে, তিনি কিন্তু সহজে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকবেন।’
বাস্তবতা মেনে নিন
তামান্না খাতুন একজন গৃহিণী। তাঁর এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলে পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে, মেয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে। তামান্নার স্বামী আবদুস সবুর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। সবুরের মা লুৎফুন্নেসার বয়স এখন ৭০ বছর। বয়সজনিত নানা রোগে আক্রান্ত তিনি।
বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের একটা বড় অংশ বৃদ্ধ মানুষ।
তামান্না খাতুন বলছিলেন, ‘করোনাভাইরাস নিয়ে অনলাইনে, পত্রিকায়, টেলিভিশনে সর্বশেষ সব খবর জানছি। করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশেও দুজন মানুষ মারা গেছেন, যাঁরা বৃদ্ধ। ঘরে আমার বৃদ্ধ শাশুড়ি। আমার বাচ্চারা আজ ঘরে বন্দী। তবে চাকরির কারণে স্বামী ঘরের বাইরে যাচ্ছেন। ভয় হয়, যদি আমরাও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হই।’
তামান্নার মতো আরও অনেকের মধ্যে এ ভয় কাজ করছে।
মনোরোগ চিকিৎসক মেখলা সরকার মনে করেন, করোনাভাইরাস নিয়ে যে বাস্তবতা, সেটা মেনে নিতে হবে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মেখলা সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনাভাইরাস সম্পর্কে আমাদের তেমন কোনো ধারণা নেই। যে জিনিসটা আমরা আসলে জানি না, সেই জিনিসটা আমাদের মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি করে। অনিশ্চয়তা থেকে আমাদের মধ্যে একধরনের ভয় হয়। ভয়টা আতঙ্কে রূপ নিতে পারে। যখন মানুষের করার কিছু থাকে না, তখন কিন্তু মানুষের মধ্যে একধরনের অসহায়ত্ব তৈরি করে। অসহায়ত্ব মানুষের মধ্যে একধরনের মানসিক চাপ তৈরি করে। ব্যক্তিবিশেষে একেকজনের মানসিক চাপ একেক রকমের। কারও হয়তোবা সামান্য ভয় লাগছে, কেউ হয়তোবা শঙ্কার মধ্যে আছে, অনেকে সাংঘাতিক আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছেন।’
মেখলা সরকার বলেন, ‘যখনই উদ্বেগ, ভয় মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে, তখন আমাদের মস্তিষ্ক বডি (শরীর) থেকে কিছু নিউরো কেমিক্যাল মোবিলাইজড করে। এটা যদি ক্রনিক হয়ে যায়, তখন আমাদের মধ্যে কিছু উপসর্গ তৈরি হয়। আমাদের যে ইন্টারনাল অর্গান সিস্টেম আছে, যেমন: ফুসফুস, লিভার, কিডনি, সেটাকে কিন্তু ইফেক্ট করবে। অনেকের মাথাব্যথা হতে পারে। কারও মাথা ঘোরাচ্ছে। কারও ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ঘুম হচ্ছে না। অনেকের শ্বাসকষ্ট হতে পারে। এই শারীরিক সমস্যাগুলো তাঁদেরই বেশি হবে, যাঁরা আগে থেকে উদ্বেগপ্রবণ। এর বাইরে মেন্টালও ইফেক্ট হয়। শারীরিক উপসর্গের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক উপসর্গও দেখা দেয়। অনেকে খিটখিটে হয়ে যাবে। অল্পতে রেগে যাবে।’
মনোরোগ চিকিৎসক মেখলা সরকার মনে করেন, ‘করোনাভাইরাসের এই কঠিন সময়টা আমাকে মেনে নিতে হবে। আমি যদি এটা মেনে না নিই, তাহলে কিন্তু আমি এটা ফেস করতে পারব না। এই পরিস্থিতি নতুন ধরনের একটা চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ আমাকে মোকাবিলা করতে হবে। জীবনের কোনো কিছুই কিন্তু স্থায়ী না। যত দুঃসময় আসুক, এগুলো স্থায়ী না। এই পরিস্থিতি কিন্তু শেষ হবে। করোনাভাইরাস চলে গেলে অর্থনৈতিক মন্দা আসতে পারে। সেটাও কিন্তু চিরস্থায়ী নয়। সেখান থেকেও কিন্তু আমাদের বেরিয়ে আসার সুযোগ আছে। এই বিশ্বাস কিন্তু আমাদের মধ্যে রাখতে হবে। এই পরিস্থিতি আমরা কোনোভাবে এড়িয়ে যেতে পারব না। আমরা যদি খুব আতঙ্কগ্রস্ত হই, উদ্বিগ্ন হই, তাতে আমাদের কোনো লাভ নেই।’
আরও পড়ুন: