করোনার মতো মাঙ্কিপক্স ছড়িয়ে পড়ার গতি প্রবল নয়: এ এস এম আলমগীর
মাঙ্কিপক্সের বিস্তার ঘটেছে বিশ্বের ১৫টি দেশে। করোনা মহামারির মধ্যে এর সংক্রমণ চিন্তায় ফেলেছে অনেককে। বাংলাদেশের বিভিন্ন বন্দরকে মাঙ্কিপক্স নিয়ে সতর্ক করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনির্ণয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীর মাঙ্কিপক্স নিয়ে সবিস্তারে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পার্থ শঙ্কর সাহা।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকায় বিস্তার ছিল যে মাঙ্কিপক্স, এটি সীমানা অতিক্রম করেছে। ছড়িয়েছে ১৫টি দেশে। করোনার আবহের মধ্যে থাকতে থাকতেই এই নতুন বিপত্তি এল। এবার এর বিস্তারে কোনো যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে শোনা যাচ্ছে। মাঙ্কিপক্স নিয়ে বৈশ্বিক উদ্বেগের কারণ কি এটাই?
এ এস এম আলমগীর: ভাইরাস নিয়ে আমরা যারা পড়াশোনা করি, তাদের কাছে মাঙ্কিপক্স বহু পরিচিত। স্মলপক্স নির্মূলের শেষ পর্যায়ে এসে ১৯৭০–এর দিকে কঙ্গোতে মানব শরীরে এর প্রথম সংক্রমণ হয়। ১৯৫৮ সালে বানরের মধ্যে এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর এটি মাঙ্কিপক্স হিসেবে পরিচিতি পায়। একে মাঙ্কিপক্স বলা হলেও এটি মূলত ইঁদুর বা কাঠবিড়ালিজাতীয় প্রাণীর মাধ্যমে ছড়ায়। বানর কিন্তু এর বাহক হিসেবে কাজ করে না। এসব প্রাণী যদি আক্রান্ত থাকে, তবে তাদের সংস্পর্শে এলে এটি মানুষে ছড়ায়। এখন একে ঘিরে যে বৈশ্বিক উদ্বেগ তৈরি হয়েছে এই করোনা সংক্রমণের মাঝামাঝি সময়ে, সেটি অযৌক্তিক নয়। এর আগেও কিন্তু দুই–চারটি করে মাঙ্কিপক্সে সংক্রমণ দেখা গেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমাদের এ অঞ্চলে বা ইউরোপে এটা তেমন একটা দেখা যায় না। কিন্তু এবার ইউরোপের দেশ যুক্তরাজ্য, স্পেন, পর্তুগাল, জার্মানিসহ তিনটি মহাদেশে এর সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে। তবে করোনা বা অন্য ভাইরাসের তুলনায় এর ছড়িয়ে পড়ার গতি কিন্তু প্রবল নয়। যেহেতু বিশ্বের কয়েকটি দেশে একযোগে শনাক্ত হচ্ছে, তাতেই শঙ্কাটা বেড়েছে। মাঙ্কিপক্সের ভাইরাসের দুটো ধরন। কঙ্গোতে যে ভাইরাস পাওয়া যায়, তার মৃত্যুর হার ১ থেকে ১০ শতাংশ। কিন্তু পশ্চিম আফ্রিকার ভাইরাসে মৃত্যুর হার প্রায় শূন্য বলা চলে। এবার এখনো এর উৎস খুঁজে পাওয়া যায়নি। বলা হচ্ছে, সমকামী যারা, তাদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু সেটা নির্দিষ্ট করা যায়নি। তবে কোনো একটা উৎস থাকবেই। আফ্রিকা ভ্রমণ একটি উৎস হতে পারে। যেহেতু আমরা একটি অতিমারির মধ্যে আছি, তাই সব জায়গায় মাঙ্কিপক্স নিয়ে একধরনের হইচই আছে।
আফ্রিকা অঞ্চলে কিন্তু এটি স্থানীয় একটি ভাইরাস। গত জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত হিসাব যদি দেখি, তাহলে কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে এ পর্যন্ত ১ হাজার ২০০ মতো শনাক্ত হয়েছে। ক্যামেরুনে শনাক্ত হয়েছে ২৫, মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রে ছয়জন শনাক্ত হয়েছে। তার মধ্যে দুটি মৃত্যুর ঘটনাও আছে। নাইজেরিয়াতে ৪৬ জন শনাক্ত হয়েছে। কিন্তু নাইজেরীয় অঞ্চলে যেহেতু পশ্চিম আফ্রিকার ধরন পাওয়া যায়, তাই সেখানে কোনো মৃত্যুর ঘটনা নেই। সবকিছু মিলে একটা উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
প্রশ্ন :
দেখা গেছে, এ পর্যন্ত যে ৯২ জন মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হয়েছে, তাদের প্রায় সবাই পুরুষ এবং তারা সমকামী। আমাদের দেশে তো পুরুষ সমকামীদের সংখ্যা বেশি নয়। সেদিক থেকে আমরা খানিকটা ঝুঁকিমুক্ত বলা যায়?
এ এস এম আলমগীর: বিশ্বের একপ্রান্তে একটি ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব হলে ছড়াতে তো সময় লাগে না। সমকামিতা হয়তো একটি কারণ, কিন্তু একমাত্র কারণ নিশ্চয় নয়। আপনি যেটা বলেছেন, বাংলাদেশে সমকামিতার বিষয়টি কম। সেই নিরিখে এটা ঠিক, এখানে এর ঝুঁকি কম। তবে, বাংলাদেশে সার্বিকভাবেই এ ভাইরাস নিয়ে ঝুঁকি কম। এ অঞ্চলের মধ্যে সিঙ্গাপুরে ১৯৯৩ সালে একটি কেস দেখা গিয়েছিল। এর কোনো প্রাদুর্ভাব এখনো দেখা যায়নি। তারপর যেহেতু বিশ্বের সব যোগাযোগব্যবস্থা প্রায় উন্মুক্ত, সবাই সব জায়গায় যাচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষও আফ্রিকা বেড়াতে যাচ্ছে, তাই যেকোনো জায়গা থেকে যেকোনো সময় এটা চলে আসতে পারে। তবে, একটা কথা মনে রাখতে হবে, এ ভাইরাস সহজে ছড়ায় না। আপনি যদি আক্রান্ত কারও সরাসরি সংস্পর্শে না আসেন, তবে ভাইরাসটি ছড়ানো মুশকিল। এ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের যে র্যাশ হয়, এর মধ্যে থাকা জলীয় অংশে ভাইরাসটি থাকে। কিংবা আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি–কাশির মাধ্যমেও ভাইরাসটি ছড়াতে পারে। তবে এ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা তেমন হয় না। তাই হাঁচি–কাশির আশঙ্কা কম। তবে প্রচণ্ড জ্বর ও মাথাব্যথা নিয়ে শুরু হয়। এক থেকে পাঁচ দিনের মাথায় র্যাশ হয়। সাধারণত র্যাশ মুখে তৈরি হয় পরে সারা শরীরে ছড়ায়। হাত, পায়ে অনেক বেশি র্যাশ হয়। র্যাশগুলো দেখতে চিকেনপক্সের র্যাশের মতোই। বাংলাদেশে কারও যদি এমন হয় যে বিদেশ থেকে আসার পর জ্বর বা র্যাশ দেখা দেয়, তবে তার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়া দরকার। মাঙ্কিপক্সের রোগীদের আইসোলেশনে রেখে চিকিৎসা করতে হয়। নাহলে ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে। সংক্রমণ ছড়ানো প্রতিরোধে যেসব পদ্ধতির কথা আমরা গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে বলছি, সবই এখানেও মেনে চলতে হবে। যেমন মাস্ক পরা, হ্যান্ড গ্লাভস ব্যবহার এবং প্রথম দিকের রোগীগুলোকে অবশ্যই পিপিই পরে তত্ত্বাবধান করতে হবে। যারা নমুনা সংগ্রহ করবে, তাদের প্রয়োজনীয় সুরক্ষা নিয়েই তা করতে হবে। নাহলে আমরা যে কেউ যেকোনো সময় এ প্রক্রিয়াগুলো চলার মধ্যেই আক্রান্ত হয়ে যেতে পারি।
প্রশ্ন :
মানুষ মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হতে পারে কীভাবে? এটা কি কখনো মারাত্মক হতে পারে? হলে এখানে মৃত্যুঝুঁকি কতটুকু? এর প্রতিষেধক কী?
এ এস এম আলমগীর: ভাইরাসটি কঙ্গো অঞ্চলের না পশ্চিম আফ্রিকার, এর ওপর ঝুঁকির তারতম্য আছে। কঙ্গোতে মৃত্যুর হার ১ থেকে ১০ শতাংশ আর পশ্চিম আফ্রিকার কোনো মৃত্যুঝুঁকি নেই। এখন পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়া ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং করে দেখা গেছে এগুলো পশ্চিম আফ্রিকার ধরন। আর এ পর্যন্ত আফ্রিকার বাইরে যারা আক্রান্ত হয়েছে, তাদের কারও মৃত্যুও হয়নি। এটা আসলে তেমন মারাত্মক অসুখ নয়। দুই থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে র্যাশগুলো চলে যায়। চিকেনপক্সের মতো এখানে র্যাশ শুকিয়ে যাওয়ার সময় যখন এর অংশ উঠতে থাকে, তখন সাবধান থাকতে হবে। আর চিকিৎসা এখনো লক্ষ্মণভিত্তিক। মাঙ্কিপক্সের সুনির্দিষ্ট একটি টিকা যুক্তরাষ্ট্রে অনুমোদন হয়ে আছে। যেহেতু এর প্রয়োজন হয়নি, তাই এত দিন এর উৎপাদন হয়নি, তাই এটা সহজে মিলছে না, তা স্পষ্ট। বলা হচ্ছে যে মাঙ্কিপক্সের একটি অ্যান্টিভাইরালেরও ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয়ে গেছে। কিন্তু তারও উৎপাদন হয়নি। অর্থাৎ কারও কাছেই এখন মাঙ্কিপক্সের টিকা ও অ্যান্টিভাইরাল নেই। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা চালু রাখতে হবে। র্যাশের জন্য অনেক সময় ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে। সে জন্য একটি সেকেন্ডারি অ্যান্টিবায়োটিক লাগতে পারে। জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল বা সাধারণ চিকিৎসা দরকার। তবে এ রোগের চিকিৎসা হাসপাতালে থেকে নেওয়ার জন্য সবাই বলে। এটা যাতে ব্যাপকভাবে জনগণের মধ্যে না ছড়ায়, তার জন্যই এ ব্যবস্থা। আমাদের অঞ্চলে সতর্ক থাকতে হবে। আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমরা ভাইরাসটির গতিবিধি লক্ষ করছি। এটি খুবই ধীর গতির। মানুষ থেকে মানুষে খুব সহজে ছড়ায় না। তাই এটি নিয়ে অনেক বেশি আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
প্রশ্ন :
মাঙ্কিপক্স ডিএনএ ভাইরাস। এটা কোভিড বা অন্য ভাইরাসের মতো মিউটেশন হবে না বলেই মনে করা হয়। এবারের বিস্তারে নতুন কোনো মিউটেশন হয়েছে বলে মনে হয়?
এ এস এম আলমগীর: এখন পর্যন্ত এ ভাইরাসের যতগুলো সিকোয়েন্সিং হয়েছে, সবগুলো আমরা খেয়াল করেছি। এটি একটি ডিএনএ ভাইরাস ঠিকই বলেছেন। ডিএনএ ভাইরাসেরও মিউটেশন হয়, তবে সেটা ধীর গতির। আর এবার এখন পর্যন্ত কোনো মিউটেশন হয়নি। এটা যেহেতু এনভেলাপড ভাইরাস, তাই এখানে কিছু সুবিধা আছে। যেমন আমরা করোনার ক্ষেত্রে বলেছি, ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিলে ভাইরাস নষ্ট হয়ে যায়, এ ক্ষেত্রেও তাই। এখানেও যদি পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন থাকা, মাংস হাত দিয়ে ধরার পর দুই হাত ভালো করে সাবান দিয়ে অন্তত ২০ সেকেন্ড ধুয়ে নিলে মাঙ্কিপক্স ভাইরাসের এনভেলাপ (প্রলেপ) নষ্ট হয়ে যাবে। এনভেলাপড ভাইরাস হলে সুবিধাটি আমরা পাই। তবে ভাইরাসটির মিউটেশন হবে না, তা নয়।
প্রশ্ন :
মাঙ্কিপক্সের ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী কারা?
এ এস এম আলমগীর: এ ভাইরাস শিশুদের জন্য মারাত্মক হতে পারে। গর্ভবতী এবং যাদের কোমর্বিডিটি আছে, তাদের জন্য এটা মারাত্মক হতে পারে। করোনার ক্ষেত্রেও আমরা বলেছি, যাদের কোমর্বিডিটি আছে, তাদের জন্য এই ভাইরাস বিপদ ডেকে আনতে পারে। মাঙ্কিপক্সের ক্ষেত্রেও এটা খাটে। যারা ক্যানসারের রোগী, তারাসহ সবাইকে সচেতনভাবেই সাবধান থাকতে হবে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: এরই মধ্যে আমাদের দেশের বন্দরগুলোকে মাঙ্কিপক্সের ব্যাপারে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আপনাদের কী প্রস্তুতি আছে?
এ এস এম আলমগীর: চলমান অতিমারির কারণে আমরা প্রস্তুত তো হয়েই আছি। তবে মাঙ্কিপক্সের ল্যাবরেটরির ডায়াগনিস নিয়ে সারা বিশ্বে একটা টানাপোড়েন আছে। কারণ, মাঙ্কিপক্স বিশ্বের বহু দেশে নেই। আমাদের এখন যে সক্ষমতা, তা দিয়ে আমরা পক্স নির্ণয় করতে পারব। আর সঙ্গে সঙ্গে যদি সিকোয়েন্সিং করে ফেলি, তবে আমরা ডায়াগনসিস করতে সক্ষম হব। আমরা আমাদের ল্যাবরেটরির জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছি। এর পাশাপাশি আমরা বিশ্বের অত্যাধুনিক যন্ত্রাংশ সংগ্রহের চেষ্টা করছি। বিশ্বের প্রায় সব দেশের একই অবস্থা। কারণ, বেশির ভাগ দেশে রোগটি নেই। সবাই এখন প্রথাগত পিসিআর করে, সিকোয়েন্স করে রেজাল্ট দিচ্ছে। সেটা আমাদের দেশেও আছে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
এ এস এম আলমগীর: আপনাকেও ধন্যবাদ।