>বিশ্বের অনেক দেশে কিটের চাহিদা প্রচুর। কেউ চাইলেই মানসম্পন্ন কিট পাচ্ছে না। এখনই কিট সংগ্রহের উদ্যোগ নিতে হবে।
করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষার জন্য স্বল্পতম সময়ের মধ্যে জরুরি ভিত্তিতে ৫ লাখ কিট সংগ্রহ করার পরামর্শ দিয়েছে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। রোগীদের সেবায় যথেষ্ট দুর্বলতা ও সমন্বয়হীনতার বিষয়টিও কমিটির নজরে এসেছে। কমিটি বলেছে, ভবিষ্যতের জন্য এখনই টিকার ব্যাপারে জোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসা বিষয়ে গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভায় এসব পরামর্শসহ ৮টি বিষয়ে ২২টি সুপারিশ তৈরি করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার রাজধানীর হোটেল অবকাশে ১৭ সদস্যের কমিটির এই সভা হয়। এটি ছিল কমিটির দ্বিতীয় সভা।
জাতীয় কারিগরি পরামর্শ কমিটি বলেছে, সামাজিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার অংশ হিসেবে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা পর্যায়ক্রমে শিথিল করার আগে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। হাসপাতালে সেবার মান, রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা, টিকা, অক্সিজেন সরবরাহ, কর্মপদ্ধতি, স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা, মানসিক চাপ, মুমূর্ষু রোগী ব্যবস্থাপনার মতো বিষয়গুলো কমিটির সুপারিশে রয়েছে।
পরামর্শক কমিটির আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ, কোভিড-১৯–এর জন্য নির্ধারিত হাসপাতাল পরিদর্শন এবং চিকিৎসকসহ সব ধরনের স্বাস্থ্যকর্মীর সঙ্গে কথা বলে এসব সুপারিশ তৈরি করেছি। আশা করি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এসব সুপারিশের ব্যাপারে গুরুত্ব দেবে ও দ্রুত পদক্ষেপ নেবে।’
কারিগরি কমিটির কাছ থেকে এসব সুপারিশ এমন সময়ে এল, যখন প্রতিদিন করোনা রোগী বাড়ছে। ১৮ এপ্রিল শনাক্ত রোগী ছিলেন ৩০৬ জন। এরপর প্রতিদিনই রোগীর সংখ্যা তিন থেকে পাঁচ শতাধিক ছিল। সর্বশেষ গত এক দিনে শনাক্ত সর্বোচ্চ রোগী ছিলেন ৬৪১ জন। এ নিয়ে রোগীর সংখ্যা ৭ হাজার ছাড়িয়েছে। একই সঙ্গে হাসপাতালের উপকরণের সংকটের কথা উঠছে, হাসপাতালে সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন শোনা যাচ্ছে।
সার্বিক পরিস্থিতি ও কমিটির সুপারিশের বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সেবা বিভাগ) অধ্যাপক হাবিবুর রহমান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা প্রতিটি ক্ষেত্রে কাজ করে যাচ্ছি। কমিটির সুপারিশে নতুন কিছু দেখছি না। নতুন কিছু থাকলে সে বিষয়ে বাড়তি মনোযোগ দেওয়া হবে।’ তিনি আরও বলেন, কিট কেনার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ঔষধাগার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
সরকার রাজধানীর ৯টি সরকারি ও ৬টি বেসরকারি হাসপাতালকে কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য নির্ধারণ করেছে। রাজধানীর বাইরে ৮ বিভাগে আরও ৬৪টি হাসপাতাল ঠিক করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞ ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা রাজধানীর কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে যে তথ্য পেয়েছেন, তার ভিত্তিতে সুপারিশ তৈরি করেছে পরামর্শক কমিটি। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোর পরিস্থিতি আরও খারাপ। সেগুলোর ওপর নজর দেওয়ার সময় এসে গেছে।
কিট ও ল্যাব
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দুই সপ্তাহ আগেও রোগ শনাক্তকরণ কিট মজুত পরিস্থিতি দেশবাসীকে জানাত সংবাদ বুলেটিন ও সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে। অতিসম্প্রতি সরকারের মজুতে কিট কত আছে, তা প্রকাশ করছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গতকাল বুধবার সংবাদ ব্রিফিংয়ের পর অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কাছে এক লাখের বেশি কিট আছে।’
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, মজুত কিটে খুব বেশি দিন পরীক্ষা চালানো সম্ভব হবে না। বর্তমানে ২৫টি ল্যাবরেটরিতে করোনার পরীক্ষায় কিট ব্যবহৃত হচ্ছে। অতি অল্প সময়ে আরও অন্তত ২৫টি ল্যাব তৈরির প্রক্রিয়ার কথা জানা গেছে। পাশাপাশি চলমান ল্যাবগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোরও চেষ্টা চলছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেছিলেন, দৈনিক ১০ হাজার পরীক্ষা তাঁরা করবেন। অন্যদিকে চিকিৎসার আওতায় থাকা রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। রোগীরা ভাইরাসমুক্ত হচ্ছেন কি না, তা জানার জন্য তাঁদের প্রত্যেককে দুবার পরীক্ষা করতে হয়।
এ পর্যন্ত দেশে মোট নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ৫৯ হাজার ৭০১। আর সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ৪ হাজার ৯৬৮টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে, যা এখন পর্যন্ত দেশে এক দিনে সর্বোচ্চ সংখ্যক নমুনা পরীক্ষা। আগের দিনের তুলনায় তা ১৪ দশমিক ৬৮ শতাংশ নমুনা বেশি। যদিও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জনসংখ্যার অনুপাতে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা এখনো অনেক কম।
পরামর্শ কমিটি সুপারিশে বলেছে, রোগ শনাক্তের জন্য বেশি সংখ্যক পরীক্ষা করতে হবে। ফলাফল দ্রুত জানার জন্য বেশি ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করতে হবে। তারা বলেছে, স্বল্প মেয়াদে ৫ লাখ টেস্টিং কিট সংগ্রহ করা অতীব জরুরি।
পরিচয় প্রকাশ অনিচ্ছুক একটি দাতা সংস্থার প্রতিনিধি প্রথম আলোকে বলেছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সব সময় পরীক্ষার ওপর জোর দিয়ে আসছে। বিশ্বের অনেক দেশে কিটের চাহিদা প্রচুর। কেউ চাইলেই মানসম্পন্ন কিট পাচ্ছেন না। সুতরাং এখনই কিট সংগ্রহের উদ্যোগ নিতে হবে।
পরামর্শক কমিটির আহ্বায়ক মোহাম্মদ সহিদুল্লা প্রথম আলোকে বলেছেন, পুরো মে মাস এবং জুনের শেষ পর্যন্ত কিটের দরকার হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন সদস্য বলেছেন, কিটের মজুত কম হতে থাকলে পরীক্ষার সংখ্যা কম হবে। তখন ল্যাবরেটরির সক্ষমতা ও সংখ্যা বাড়িয়ে সুফল পাওয়া যাবে না।
সেবা নিয়ে কথা
পরামর্শক কমিটির একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত সপ্তাহে তিনজন বিশেজ্ঞ ও মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা রাজধানীর কোভিড-১৯–এর জন্য নির্ধারিত হাসপাতাল ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। তাঁরা দেখেছেন, সেবায় ঘাটতি আছে। এমন ঘাটতির কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে যথেষ্ট সংখ্যক চিকিৎসক নেই, অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরও স্বল্পতা আছে।
সুপারিশে পরামর্শক কমিটি বলেছে, প্রতিটি হাসপাতালে বিভিন্ন বিষয়ের যথেষ্ট সংখ্যক জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ চিকিৎসক থাকতে হবে। পাশাপাশি সেবার মান নিশ্চিত করতে ওয়ার্ডবয় ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীর সংখ্যা বাড়াতে হবে।
চিকিৎসকসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষাসামগ্রীর (পিপিই) মান নিয়ে কমিটি সন্তুষ্ট নয়। তারা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ী পিপিই সরবরাহের কথা বলেছে। এ–ও বলেছে, পিপিইর মান দেখার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা দরকার।
কমিটি বলছে, অনেক রোগীর অবস্থার উন্নতি হলেও তাঁরা হাসপাতালে থাকছেন। কারণ, ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে পরপর দুটি পরীক্ষায় তাঁর শরীরে করোনাভাইরাস নেই এমন প্রমাণ পেতে হয়। এই পরীক্ষার জন্য হাসপাতালের শয্যা আটকে থাকছে। এসব রোগীকে বাড়িতে বা আইসোলেশন (বিচ্ছিন্নকরণ) কেন্দ্রে পাঠানোর সুপারিশ করেছে কমিটি।
আইসিইউ সেবা
সরকারি হিসাব বলছে, সারা দেশের কোভিড-১৯–এর জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) শয্যা আছে মাত্র ৩৪১টি। বিশেষজ্ঞদের প্রক্ষেপণ বলছে, ৩১ মে নাগাদ রোগীর সংখ্যা ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ হতে পারে। সেই তুলনায় আইসিইউ শয্যা খুবই কম।
এ ব্যাপারে কমিটি সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করেছে। কমিটি বলেছে, মুমূর্ষু রোগীর অক্সিজেন প্রয়োজন, সুতরাং সিলিন্ডার বাড়ানোসহ অক্সিজেন সরবরাহের সব উদ্যোগ নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, আইসিইউ সুবিধা বাড়াতে হবে। তৃতীয়ত, রোগীকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অক্সিজেন দেওয়ার জন্য ভেন্টিলেটর বাড়াতে হবে। চতুর্থত, এই বিশেষ সেবা দেওয়ার জন্য অবেদনবিদ দরকার। দেশে অবেদনবিদ আছেন। তাঁদের জরুরি ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন।
টিকা নিয়ে করণীয়
কমিটির আহ্বায়ক মোহাম্মদ সহিদুল্লা বলেন, কোভিড-১৯ প্রতিরোধে টিকাই সবচেয়ে কার্যকর হবে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী টিকা তৈরির কাজ চলছে। এ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে প্রয়োজনে অংশীদারত্বের পথে যেতে হবে। সফল টিকা তৈরির পর বাংলাদেশের সব মানুষ যেন তা পায়, সে জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এখনই যোগাযোগ গড়ে তোলা দরকার। স্বাস্থ্য বিষয়ে কাজে যুক্ত আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্যাভি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে সহায়তা করবে। তবে আগে থেকেই যোগাযোগ জোরদার করা দরকার।
কমিটি তাদের সুপারিশে বলেছে, টিকা তৈরির ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বিভিন্ন দেশে শুরু হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় একাধিক উন্নয়নশীল দেশ যুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানীদের এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়ার প্রচেষ্টা থাকা প্রয়োজন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশীদ-ই-মাহবুব প্রথম আলোকে বলেন, ‘সম্পদের স্বল্পতা আছে ঠিকই। তবে এটা বোঝা যায় যে কিছু কাজ হয়নি পরিকল্পনা ও সমন্বয়হীনতার কারণে। আশা করি, সরকার সময় নষ্ট না করে সুপারিশ বাস্তবায়নে চেষ্টা করবে। হাসপাতাল তদারকির ব্যবস্থা করতে হবে। এতে অভিযোগ কমবে ও সেবার মান বাড়বে।’