ট্রান্সকম গ্রুপের প্রয়াত চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের নাম বাংলাদেশে ব্যবসা–বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এখন নীতি ও নৈতিকতার প্রতীক। একজন নীতির মানুষ, নীতির উদ্যোক্তা—লতিফুর রহমানের মৃত্যুর পর তাঁর সম্পর্কে এ কথাটাই বলেছেন প্রায় সবাই। ব্যতিক্রমী এই উদ্যোক্তার জীবন, কৃতি, স্বীকৃতি সম্পর্কে লেখা–ছবি–ভিডিওতে সার্বিক ধারণা পাওয়া যাচ্ছে অনুপম একটি ওয়েবসাইটে (www.latifurrahman.com)। প্রথম আলোর উদ্যোগে ২৮ আগস্ট লতিফুর রহমানেরই জন্মদিনে ইন্টারেনেটে প্রকাশিত হয়েছে বাংলা ও ইংরেজি—দ্বিভাষিক এই ওয়েবসাইট।
২০২০ সালের ১ জুলাই কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের চিওড়া গ্রামে নিজ বাড়িতে মারা যান লতিফুর রহমান। হোলি আর্টিজান ট্র্যাজেডির ঠিক চার বছর পর। কী আশ্চর্য, ২০১৬ সালের এই দিনে হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় নিহত হয়েছিলেন তাঁর নাতি ফারাজ আইয়াজ হোসেন।
গত ১ জুলাই ছিল লতিফুর রহমানের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আর ফারাজ নিহত হওয়ার পাঁচ বছর। জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফের আহ্বানে বসলাম ফিচার সম্পাদক সুমনা শারমীন, তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের কিউ এম আশফাক আলী আর আমি। সাজ্জাদ ভাই যা বললেন, তার সারাংশ, লতিফুর রহমানের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে তাঁকে বিশেষ শ্রদ্ধা জানানো হবে। প্রথম আলো ডটকমে একটি ওয়েব পেজ করা হবে তাঁকে নিয়ে। সেখানে থাকবে তাঁর জীবনরেখা, ছবি, ভিডিও, তাঁকে নিয়ে লেখা স্মৃতি ও মূল্যায়ন এবং তাঁর বিপুল উদ্যোগ ও সাফল্যের গাথা।
লতিফুর রহমান আর তাঁর নাতি ফারাজ আইয়াজ হোসেনের জীবন নানাভাবে অবিচ্ছেদ্য হয়ে উঠেছে। বন্ধুদের জন্য জীবন দিয়ে ফারাজ হয়ে উঠেছেন সাহসিকতারও প্রতীক। তাই এই পেজে ফারাজের জন্যও একটি বিভাগ থাকবে।
কথা হলো, ওয়েব পেজের কারিগরি অংশ সামলাবেন আশফাক আলী। আর আমরা লেখা, ছবি, ভিডিও, লতিফুর রহমানের সংক্ষিপ্ত জীবনী—এসব গুছিয়ে দেব।
১ জুলাই লতিফুর রহমান পরিবারের জন্য শোকাবহ। পরিবারের সদস্যরা এদিন কোনো অনুষ্ঠানে অংশ নেন না, একান্তে কাটান। কিন্তু লতিফুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা ট্রান্সকমের গ্রুপ সিইও সিমিন রহমান এবং তাঁর ছেলে যারেফ আয়াত হোসেন যোগ দিলেন ওয়েব পেজ প্রকাশের ভার্চ্যুয়াল আয়োজনে। সে অনুষ্ঠানে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বললেন, প্রথম আলোর প্রথম দিন থেকেই লতিফুর রহমান সব বিষয়ে যুক্ত থেকেছেন, নেতৃত্ব ও পরামর্শ দিয়েছেন। আজও তিনি আছেন।
ওয়েব পেজ করার সময়ই পরিকল্পনা ছিল লতিফুর রহমানকে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ ওয়েবসাইট প্রকাশ করার। মতিউর রহমান ঘোষণা করলেন, ২৮ আগস্ট লতিফুর রহমানের জন্মদিনেই সেই ওয়েবসাইট প্রকাশ করা হোক।
সাইটের ডোমেইন কেনা হয়ে গিয়েছিল আগেই। এবার কনটেন্ট সাজানো–গোছানো, কনটেন্ট সংগ্রহের পালা। সাজ্জাদ শরিফের নেতৃত্বে শুরু হলো কাজ। পেজে আমরা প্রথম আলোর আলোকচিত্রীদের তোলা লতিফুর রহমানের ছবি ব্যবহার করেছি। প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে দেওয়া তাঁর বক্তব্যের কয়েকটি ভিডিও এতে আছে।
‘শূন্য থেকে আবার শুরু’ শিরোনামে লতিফুর রহমানের নিজের একটি লেখা আছে ওয়েবসাইটে। সেখানে আছে উদ্যোক্তা হিসেবে তাঁর সংগ্রামের অসামান্য গল্প। স্বাধীনতার পর পাটকল সরকারীকরণের কারণে পারিবারিক জুট মিলস যখন সরকার নিয়ে নেয়, তখন একরকম শূন্য থেকে শুরু করতে হয়েছিল তাঁকে। নীতি আর নৈতিকতা দিয়েই তাঁর প্রতিষ্ঠিত ট্রান্সকম গ্রুপ আজ দেশের অন্যতম নেতৃস্থানীয়, দ্রুত বর্ধমান ও বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
ওয়েবসাইটে প্রথম বাংলাদেশি ব্যবসায়ী হিসেবে পৃথিবীর ব্যবসাক্ষেত্রের নোবেল হিসেবে পরিচিত ‘অসলো বিজনেস ফর দ্য পিস অ্যাওয়ার্ড’ পাওয়া লতিফুর রহমানের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায় নানাজনের লেখা থেকে। মানুষ ও উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি যে বিনয়ী, ভবিষ্যৎদ্রষ্টা, নীতিমান এবং মুক্ত গণমাধ্যমের পথিকৃৎ, তা রেহমান সোবহান, আনিস–উদ দৌলা, তারিক করিম, মতিউর রহমান, মাহ্ফুজ আনাম, আসাদুজ্জামান নূর, সিমিন রহমান, সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, আনিসুল হক প্রমুখের লেখায় উঠে এসেছে।
আমাদের ইচ্ছা লতিফুর রহমানের বিভিন্ন বয়সের এবং পারিবারিক ছবি যতটা পারা যায় ওয়েবসাইটে রাখা। সিমিন রহমানের কাছ থেকে জানা গিয়েছিল, লতিফুর রহমান–শাহনাজ রহমানের ৫০তম বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে পারিবারিক অ্যালবাম এবং ট্রান্সকম গ্রুপের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের হাজার হাজার ছবি ডিজিটাল ফরম্যাটে রূপান্তর করে রেখেছিল এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। সেখান থেকে বাছাই করে ছবি নিয়ে আসার দায়িত্ব দেওয়া হলো ফটোসাংবাদিক জিয়া ইসলামকে। তিন–চার দিন ধরে জিয়া এসকেএফে গিয়ে ছবি নিয়ে এলেন। এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালসের নির্বাহী পরিচালক (বিপণন ও বিক্রয়) মোহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলাম পুরো ব্যাপারটিতে দারুণ সহযোগিতা করলেন। তাঁর কাছ থেকেই জেনেছি, চূড়ান্তভাবে বাছাই করা পারিবারিক ছবিগুলো সিমিন রহমান নিজে দেখে দিয়েছেন।
ছবি সংগ্রহের সময় লতিফুর রহমান ও তাঁর পরিবারের অসংখ্য ছবি দেখে তাঁদের নতুন করে জানার কথা বললেন জিয়া। ওয়েবসাইট উদ্বোধনের সময় সিমিন রহমান বলেছিলেন, ‘আব্বু সব সময় ডকুমেন্টেশনের কথা বলতেন। হয়তো কোথাও বেড়াতে গেছেন বা কোনো অনুষ্ঠানে, সেগুলোর ছবি তুলে রেখে সংরক্ষণ করার কথা বলতেন। নিজেও ক্যামেরা হাতে ছবি তুলতেন। বলতেন, একদিন এগুলো অমূল্য স্মৃতি হয়ে থাকবে।’
আমরা পেলাম লতিফুর রহমানের শৈশব থেকে শুরু করে জীবনের সব সময়ের ছবি। তরুণ পেশাজীবী, প্রেমময় স্বামী, স্নেহময় পিতা, নাতিদের সঙ্গে উচ্ছল দাদা–নানা, অসামান্য একজন ব্যবসায়ীর প্রতিকৃতি দেখা যায় ছবিগুলোতে।
ওয়েবসাইটের আধেয় তৈরিতে সরাসরি সহযোগিতা করলেন যারেফ আয়াত হোসেনও। লতিফুর রহমান ও ট্রান্সকম গ্রুপের দীর্ঘ সময়রেখা যত্ন করে লিখে পাঠালেন। ছোট ভাই ফারাজকে নিয়েও আছে তাঁর নতুন একটি লেখা।
এটা যেহেতু দ্বিভাষিক ওয়েবসাইট, তাই এই প্রক্রিয়ায় অনিবার্য হয়ে উঠলেন প্রথম আলোর ইংরেজি অনলাইন সংস্করণের প্রধান আয়েশা কবির। সম্পাদনা, বাংলা লেখার অনুবাদ—যখনই প্রয়োজন হয়েছে, তিনি সেগুলো করে দিয়েছেন। টাইমলাইন বাংলায় অনুবাদের কাজটি করে দিয়েছেন জাওয়াদুল আলম, কনটেন্ট গোছানোর ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছেন সামিহা আকবর।
সাহসিকতার প্রতীক ফারাজ আইয়াজ হোসেনকে নিয়ে আলাদা বিভাগ রয়েছে ওয়েবসাইটে। সেখানে তাঁকে নিয়ে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ছোটু যেমন আছে, তেমনি আছে ফারাজের দেশি–বিদেশি বন্ধুদের লেখা এবং তাঁর বিভিন্ন ছবি।
এই ওয়েবসাইটের লক্ষ্য শুধু লতিফুর রহমানকেই তুলে ধরা নয়, বরং তার চেয়ে বেশি। এর উদ্দেশ্য তরুণ প্রজন্মের সামনে নৈতিক শিল্প উদ্যোগের একটি বিরল উদাহরণ তুলে ধরা, তাদের অনুপ্রাণিত করা। ভবিষ্যতের তরুণ উদ্যোক্তাদের মধ্য দিয়েই লতিফুর রহমানের মূল্যবোধের প্রকৃত উত্তরাধিকার বয়ে যাবে।
পল্লব মোহাইমেন: যুগ্ম ফিচার সম্পাদক