একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বেসরকারি ফলাফল অনুযায়ী সরাসরি নির্বাচিত নারীর সংখ্যা ২২ জন। এর মধ্যে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাসহ ১৯জনই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত। এর বাইরে জাতীয় পার্টি থেকে দুজন এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ থেকে একজন নারী নির্বাচিত হয়েছেন।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সংসদ নির্বাচনে এবারই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক নারী নির্বাচিত হয়েছেন। এবারের নির্বাচনে নারী প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ৬৯ জন, যা এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত সব নির্বাচনের মধ্যে ছিল সর্বোচ্চ নারী প্রার্থী। তাই বেশি সংখ্যক নারী নির্বাচিত হবেন সে প্রত্যাশা ছিল নির্বাচন বিশ্লেষক এবং নারী অধিকার নিয়ে কর্মরতদের। তাঁরা বলছেন, ৬৯ জন প্রার্থীর মধ্যে ২২ জন নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টিকে বলা যায়, প্রার্থীর দুই-তৃতীয়াংশই বিজয়ী হতে পারেননি। নির্বাচিত নারীরা সংসদে গিয়ে দল নয়, নারী গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করবেন সে প্রত্যাশা করছেন তাঁরা।
এবারও ঘুরেফিরে একই নারী বা পরিচিত মুখগুলোই নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। এবার নির্বাচিতদের মধ্যে আওয়ামী লীগ থেকে কুমিল্লা ২ আসন থেকে নারী উদ্যোক্তা সেলিমা আহমাদ এবং কক্সবাজার ৪ আসন থেকে শাহীন আকতার চৌধুরী নতুন মুখ হিসেবে এসেছেন। শাহিন আক্তার আওয়ামী লীগের বিতর্কিত সাংসদ আবদুর রহমান বদির স্ত্রী। স্বামী মনোনয়ন না পাওয়ায় তিনি নির্বাচন করেন। এর বাইরে নির্বাচিত অন্য নারীরা দশম সংসদেও পরিচিত মুখ ছিলেন ।
নির্বাচিত নারী প্রার্থীরা বর্তমানে এলাকায় ভোটারদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। দশম জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরিন শারমীন চৌধুরী এবার রংপুর ৬ আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। দশম সংসদে তিনি উপনির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে সংসদে আসেন। এর আগে সংরক্ষিত সাংসদ হিসেবে সংসদে দায়িত্ব পালন করেন এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন।
আজ সোমবার টেলিফোনে শিরিন শারমীন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন,‘ নির্বাচিত হওয়ার পর ভোটারদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করছি। তাই বলা যায়, ব্যস্ত সময় পার করছি।’
এবার সংসদ নির্বাচনে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের শিরিন আখতার (ফেনী ১) থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। টেলিফোনে শিরীন আখতার বলেন,‘ নারীদের নির্বাচনে জিতে আসা অনেক কঠিন ব্যাপার। আমাকে জিতে আসতে অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছে।’ শিরীন আখতারও দশম সংসদের নির্বাচিত সাংসদ ছিলেন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোট ১ হাজার ৮৪৮ জন প্রার্থীর মধ্যে স্বতন্ত্রসহ মোট ৬৯ জন প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নেন। এবার মোট ৩৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নেয়।
নির্বাচনে নারীদের অংশ নেওয়া এবং জিতে আসা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম প্রথম আলোকে বলেন, এবার নির্বাচনে অংশ নেওয়া নারী প্রার্থীর সংখ্যা বেশি থাকায় নির্বাচিত নারীর সংখ্যা বাড়বে বলে প্রত্যাশা ছিল। সে তুলনায় প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। কেননা, নির্বাচনের পদ্ধতি, নির্বাচনে মাংসপেশি এবং অর্থের যে দাপট তা পাল্টায়নি। তবে যে নারীরা নির্বাচিত হলেন তাঁদের সাংসদের দায়িত্বের বাইরে নারী জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসেবে বাড়তি দায়িত্ব পালন করতে হবে। তাঁদের মনে রাখতে হবে নারী আন্দোলনের ধারাবাহিকতার কারণেই তাঁরা সংসদে দায়িত্ব পালন করছেন। তাই নারী সাংসদদের সংসদে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখতে হবে। নারী আন্দোলন বা নারী বিষয়ে সংসদে সোচ্চার হতে হবে।
প্রথম নারী সাংসদ নির্বাচিত হন তৃতীয় সংসদে ১৯৭৯ সালে। এরপর ১৯৮৬ সালে ৫ জন, ১৯৮৮ সালে ৪ জন নারী সরাসরি নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনগুলোতে মোট কতজন করে নারী প্রার্থী ছিলেন সে পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। ১৯৯১ সালের হিসাব অনুযায়ী ৩৯ জন প্রার্থীর মধ্যে ৫ জন, ১৯৯৬ সালের জুন মাসের নির্বাচনে ৩৬ প্রার্থীর মধ্যে ৮ জন, ২০০১ সালের নির্বাচনে ৩৮ জন প্রার্থীর মধ্যে ৬ জন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে ৫৯ জন প্রার্থীর মধ্যে ১৯ জন, ২০১৪ সালের নির্বাচনে ২৯ জন প্রার্থীর মধ্যে ১৮ জন নারী নির্বাচিত হয়ে সাংসদ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তবে এই সংসদে সাংসদ স্বামীর মৃত্যুর পর উপ নির্বাচনে তিনজন, স্বামীর ছেড়ে দেওয়া আসনে ১ জন এবং প্রধানমন্ত্রীর ছেড়ে দেওয়া আসনে একজন সহ মোট ৫ জন নারী বিভিন্ন সময়ে সাংসদ নির্বাচিত হয়ে আসেন।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়ন, মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা ব্রতীর প্রধান নির্বাহী শারমীন মুরশিদ বলেন, এবারের নির্বাচনে অংশ নেওয়া নারী প্রার্থীদের বেলায় বলা যায়, দলভিত্তিক হিসেবে খুব বেশি নারী মনোনয়ন পাননি। আর আওয়ামী লীগ থেকে বরাবরই নারীরা বেশি মনোনয়ন পান এবং শাসক দল হিসেবে দল থেকে জিতে আসা নারীর সংখ্যা বেশি থাকবে তা প্রত্যাশা অনুযায়ীই হয়েছে। তবে নারী প্রার্থী বা নির্বাচিত নারীদের নিয়ে সে অর্থে বলার মতো নতুন কিছু নেই। গত ১০ বছর ধরে প্রথাগতভাবেই এটি চলে আসছে। এ ক্ষেত্রে খুব উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে তা বলার উপায় নেই।
বর্তমানে আওয়ামী লীগ নতুন সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য নতুন সরকারকে সুস্পষ্ট কিছু নীতি গ্রহণ করতে হবে। স্থানীয় সরকারে যে নারীরা নির্বাচিত হচ্ছেন তাঁদের ভূমিকা স্পষ্ট করতে হবে। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানো এবং গুণগত পরিবর্তনে সরকারকে কাজ করতে হবে বলে উল্লেখ করেন শারমীন মুরশিদ।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নারী প্রার্থীদের মনোনয়ন দিলেও জিতে আসার জন্য দলগতভাবে যে পরিমাণ সমর্থন দেওয়া দরকার তা দেয় না। ফলে জিতে আসা নারীর সংখ্যা কমে যায়।
নারী আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, নতুন সরকারকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অংশ গ্রহণ বাড়ানোর পাশাপাশি নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং মর্যাদার আসনে বসানোর দিকটিতেও নজর দিতে হবে। আর নির্বাচিত সাংসদেরা সংসদে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে এবং নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে সোচ্চার ভূমিকা পালন করবেন। নারী সাংসদের মনে রাখতে হবে, সংসদে তাঁরা নারী জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছেন, তাই দলীয় স্বার্থের বাইরে এই গোষ্ঠীর অধিকার আদায়ে সোচ্চার হতে হবে। প্রত্যাশা থাকবে, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী যারা নারীর অধিকারকে সম্মান করে না সে ধরনের গোষ্ঠীর সঙ্গে নারী সাংসদেরা কোনো আঁতাত করবেন না। নারী প্রার্থী
একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী নারীরা হলেন:
গোপালগঞ্জ-৩ :: শেখ হাসিনা
রংপুর-৬ :: শিরীন শারমিন চৌধুরী
গাইবান্ধা-২ :: মাহাবুব আরা বেগম গিনি
শেরপুর-২ :: মতিয়া চৌধুরী
নেত্রকোনা-৪ :: রেবেকা মমিন
সুনামগঞ্জ-২ :: জয়া সেনগুপ্ত
যশোর-৬ :: ইসমাত আরা সাদেক
বাগেরহাট-৩ :: হাবিবুন নাহার
খুলনা-৩ :: মন্নুজান সুফিয়ান
মানিকগঞ্জ-২ :: মমতাজ বেগম
মুন্সিগঞ্জ-২ :: সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি
ঢাকা-১৮ :: সাহারা খাতুন
গাজীপুর-৪ :: সিমিন হোসেন রিমি
গাজীপুর-৫ :: মেহের আফরোজ চুমকি
কুমিল্লা-২ :: সেলিমা আহমেদ মেরী
চাঁদপুর-৩ :: দীপু মনি
নোয়াখালী-৬ :: আয়েশা ফেরদাউস
কক্সবাজার-৪ :: শাহিনা আক্তার চৌধুরী
ফরিদপুর-২ :: সাজেদা চৌধুরী
ফেনী-১ :: শিরীন আখতার (জাসদ)
ময়মনসিংহ-৪ :: রওশন এরশাদ (জাতীয় পার্টি)
বরিশাল-৬ :: নাসরিন জাহান রতনা (জাতীয় পার্টি)