সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে পুলিশের ট্রাফিক সপ্তাহের মধ্যেই এবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গাড়িকে পেছন থেকে ধাক্কা দিল বেপরোয়া বাস। গতকাল শুক্রবার রাত সোয়া নয়টার দিকে রাজধানীর হৃদরোগ হাসপাতাল এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গাড়িকে ধাক্কা দেওয়া যাত্রীবাহী বাসটি তখন চালাচ্ছিলেন হেলপার (চালকের সহকারী)। অবশ্য চালক তখন বাসেই ছিলেন। ঘটনার পর পুলিশ বাসটির চালক ও সহকারী দুজনকেই আটক করেছে।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরপরই এ ঘটনা ঘটল। এই আন্দোলনের মধ্যেই সড়কের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ট্রাফিক সপ্তাহ শুরু করে পুলিশ।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের গাড়িকে বাসের ধাক্কা দেওয়ার বিষয়ে শেরেবাংলা নগর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবুল কালাম আজাদ গত রাত একটায় মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গাড়িটি হৃদরোগ হাসপাতাল এলাকা থেকে নাখালপাড়ার দিকে যাচ্ছিল। পথে ওই দুর্ঘটনা ঘটে। বাসটি মিরপুর থেকে মতিঝিল রুটে চলে। ঘটনার পরপরই রাস্তায় দায়িত্ব পালন করা ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা বাসটি আটক করেন। চালক ইব্রাহিম খলিল ও সহকারী মানিককে থানায় আনা হয়েছে। দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। বাসটিও থানায় এনে রাখা হয়েছে।
পুলিশ জানায়, বাসের ধাক্কায় মন্ত্রীর গাড়ির পেছনের অংশ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে মন্ত্রীসহ গাড়ির আরোহীদের কোনো ক্ষতি হয়নি।
এদিকে সড়কে নৈরাজ্য বন্ধে গত ছয় দিনে সারা দেশে ট্রাফিক আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪২৩ টি। জরিমানা আদায় করা হয়েছে ৩ কোটি ৭৭ লাখ ৫৯ হাজার টাকা।
গত ছয় দিনে ৪০ হাজার ৬০৩ জন চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আটক করা হয়েছে ৩ হাজার ৫৪৪টি যানবাহন। মামলা ও জরিমানার পাশাপাশি যানবাহনের চালক ও পথচারীদের উদ্দেশে প্রচার করা হচ্ছে সচেতনতামূলক বার্তা।
এসব মামলার মধ্যে ৪০ হাজারের বেশি মামলা হয়েছে রাজধানীতে। জরিমানার প্রায় ২ কোটি টাকাই আদায় হয়েছে রাজধানীতে। এত কিছুর পরও রাজধানীর সড়কে কমছে না নৈরাজ্য। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর ছয়টি ব্যস্ত বাসস্ট্যান্ড এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সড়কে যানবাহন ও পথচারী অন্যান্য দিনের তুলনায় কম। এরপরও যানবাহনচালক এবং পথচারীদের নিয়ম অমান্য অনেক ক্ষেত্রেই আগের মতো চলছে। ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা বলছেন, মানুষ আইন ভাঙছে। তাঁরাও মামলা দিচ্ছেন। অনেকে আগের চেয়ে সচেতন হলেও সংখ্যায় তা কম।
মিরপুর ১ নম্বর গোলচত্বর, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, ফার্মগেট, বাংলামোটর, কারওয়ান বাজার এবং সায়েন্স ল্যাব এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি সিগন্যালে ট্রাফিক পুলিশের পাশাপাশি বেশ কয়েকজন সাধারণ পুলিশ সদস্য ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন। ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা যানবাহনের নিবন্ধন, লাইসেন্স, ফিটনেস, বিমার কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করছিলেন।
গাবতলীর পর্বত সিনেমার কিছু আগে পুলিশ বক্স। ঢাকায় যে যানবাহন ঢুকছে তার অধিকাংশের কাগজপত্র পরীক্ষা করছিলেন পুলিশ সদস্যরা। একটু সামনে পুলিশের রেকার রাখা। দুজন সার্জেন্ট কাগজপত্র পরীক্ষা করে মামলা দিচ্ছিলেন।
গাবতলী এলাকায় দায়িত্বরত ট্রাফিক সার্জেন্ট জসিম উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে আগের থেকে বেশি সজাগ আছি। মামলাও হচ্ছে আগের থেকে বেশি। মানুষকে সচেতন হতে হবে। মোটরসাইকেলে হেলমেট ব্যবহার এবং বৈধ কাগজ সঙ্গে থাকলে কোনো সমস্যা নেই।’
মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে আরোহীর হেলমেট না থাকায় ২০০ টাকা মূল্যের একটি মামলা করেন ট্রাফিক সার্জেন্ট। হেলমেট না থাকার বিষয়ে চালক মনসুর আহমেদ বলেন, ‘এত দিন পুলিশ চালকের হেলমেট না থাকলে মামলা দিত। চালকের হেলমেট ছিল। আরোহীর হেলমেট বাধ্যতামূলক লাগবেই জানতাম না। এখন থেকে রাখব।’
গত ছয় দিনে ট্রাফিক সদস্যরা যত মামলা দিয়েছেন এর মধ্যে ২১ হাজারের বেশি মামলা মোটরসাইকেলের বিরুদ্ধে। এ সময় মোটরসাইকেল আটক করা হয়েছে প্রায় ৮৫০ টি।
মিরপুর ১ নম্বর এলাকায় দেখা যায়, বাসের অপেক্ষায় থাকা যাত্রীরা সড়কের মাঝামাঝি চলে এসেছেন। একটি বাস এলে যাত্রীরা তাতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। বাসচালকেরা সড়কের মাঝখানেই বাস থামিয়ে যাত্রী নামাচ্ছেন, ওঠাচ্ছেন। অথচ বাস দাঁড়ানোর নির্ধারিত জায়গা এর থেকে কিছুটা সামনে।
ট্রাফিক পুলিশের পক্ষ থেকে পথচারীদের যত্রতত্র পারাপার না হতে আহ্বান জানানো হচ্ছে। দেখা যায়, বাংলামোটর মোড়ে লোকজন ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার হচ্ছেন। দুই পাশেই লোকজন সড়ক পার হওয়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন। চলন্ত গাড়ির মাঝখানে কিছুটা ফাঁকা জায়গা পেলেই দৌড় দিচ্ছেন। অথচ মোড়ের ওপরেই পদচারী-সেতু।
রাজধানীতে ট্রাফিক সপ্তাহের প্রথম দিনে মামলা হয় ৭ হাজার ৮১ টি, জরিমানা আদায় হয় ৪২ লাখ ১৮ হাজার ৫০০ টাকা। ওই দিন ৫৭টি গাড়ি ডাম্পিং ও ৭০৮টি গাড়ি রেকার করা হয়। দ্বিতীয় দিন ৭ হাজার ৩১৯টি মামলা হয় ও ৪৬ লাখ ৬৭ হাজার ৭২ টাকা জরিমানা হয়। এ সময় ১৪২টি মোটরসাইকেল আটকসহ ৮৩৭টি গাড়ি ডাম্পিং ও রেকার করা হয়।
তৃতীয় দিনে ৯ হাজার ৪৭০টি মামলা ও ৫৪ লাখ ২৫ হাজার ৭৫০ টাকা জরিমানা করা হয়। ৯৯৯টি গাড়ি ডাম্পিং ও রেকার করা হয়। চতুর্থ দিনে ৯ হাজার ৯৭৪টি মামলা ও ৪৬ লাখ ৩০ হাজার ২০ টাকা জরিমানা করা হয়। এ সময় ১ হাজার ৫৭টি গাড়ি ডাম্পিং ও রেকার করা হয়। পঞ্চম দিনে ৪ হাজার ৪৮৪টি মামলা হয়।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মীর রেজাউল আলম প্রথম আলোকে বলেন, জনগণকে সচেতন করাই ট্রাফিক সপ্তাহের উদ্দেশ্য। যেন জনগণের মধ্যে আইন মানার মানসিকতা গড়ে ওঠে। নিয়মিত মামলার পাশাপাশি পদচারী-সেতু ব্যবহার না করা, যততত্র পারপারের কারণেও মামলা ও জরিমানা করা হয়েছে।