এবার লোকসান থামাতে রেলের ভাড়া বাড়ছে

.
.

সাড়ে তিন বছরের মাথায় আবার রেলের ভাড়া বাড়ছে। এবার সাড়ে ৭ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাব করে বলা হয়েছে, এখন থেকে প্রতিবছরই ভাড়া বাড়বে। এবারও প্রধান কারণ বলা হয়েছে রেলওয়ের লোকসান কমানো।
তবে রেলওয়েরই সূত্র জানায়, একজন যাত্রী পরিবহন করে প্রতি কিলোমিটারে মাত্র ৫৭ পয়সা আয় করে রেল। কাজেই সামান্য ভাড়া বাড়িয়ে রেলের ৯০০ কোটি টাকার মতো লোকসান কখনোই মেটানো সম্ভব নয়। জবাবে কর্মকর্তারা বলছেন, লোকসানের রাশ টেনে ধরতেই ভাড়া বাড়ানো হচ্ছে।
নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী ঢাকা-চট্টগ্রামের শোভন চেয়ারের বর্তমান ৩২০ টাকার ভাড়া ৩৪৫ টাকা হবে। আর প্রথম শ্রেণির ৬১০ টাকার ভাড়া হবে ৬৫৬ টাকা। মালামাল পরিবহনের জন্য ২০ ফুটের একটা কনটেইনারের আগের ৯ হাজার টাকা ভাড়া বেড়ে ৯ হাজার ৭০০ টাকা হবে। প্রতিদিন প্রায় দুই লাখ যাত্রী রেলপথে যাতায়াত করেন।
এর আগে ২০১২ সালে ভাড়া বাড়ানো হয়েছিল ৫০ শতাংশ। পাশাপাশি ভর্তুকি তুলে দেওয়ায় টিকিটের দাম শ্রেণিভেদে ৭০ থেকে ১১০ ভাগ পর্যন্ত বেড়ে গিয়েছিল। তখন এই বিপুল ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে সমালোচনার জবাবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলেছিল, লোকসান কমানো আর যাত্রীসেবা বাড়ানোই ভাড়া বৃদ্ধির কারণ। কিন্তু তিন বছর পর সেবার চিত্রটি যে খুব একটা বদল হয়েছে, তা খোদ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষও দাবি করছে না। উল্টো রেলের লোকসান বাড়তে শুরু করেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের সাবেক মহাপরিচালক মো. তাফাজ্জল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘একসময় সারা দেশে যে মালামাল পরিবহন হতো, তার বড় অংশই রেলপথে হতো। এখন রেল যাত্রীনির্ভর হয়ে গেছে। কিন্তু যাত্রী পরিবহন করে রেলের আয় একেবারেই সামান্য। কাজেই যাত্রীর ভাড়া বাড়িয়ে বিপুল পরিমাণ লোকসান কমানো অসম্ভব। এর বদলে যদি কনটেইনার ও মালামাল পরিবহন বাড়ানো যায়, তাহলে হয়তো লোকসানের এই বিরাট অঙ্কে আঁচড় কাটা সম্ভব।’
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মোজাম্মেল হক বলেন, রেল লোকসানের কথা বলে ভাড়া বাড়াচ্ছে। কিন্তু রেলের ভূমির বাণিজ্যিক ব্যবহার বাড়ানো, রেলের জমির ইজারামূল্য বাড়ানো, সক্ষমতা অনুযায়ী প্রতিটি ট্রেনে বগি সংযোজনসহ কিছু উদ্যোগ নিলে রেলওয়ের আয় বাড়ানো যেত। তারা সেদিকে না গিয়ে যাত্রীদের ওপর চাপ তৈরি করছে। তিনি বলেন, আগের বার ভাড়া বাড়ানোর সময় যাত্রীসেবার মান বাড়ানোর যে অঙ্গীকার করা হয়েছিল, সেটি বাস্তবায়িত হয়নি।
কাগজপত্রে দেখা যায়, ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৭৫৮ কোটি টাকা, ২০১০-১১ অর্থবছরে ৯৫৮ কোটি টাকা ও ২০১১-১২ অর্থবছরে ১৫৫০ কোটি টাকা লোকসান দেয় রেলওয়ে। তবে ২০১২ সালের ১ অক্টোবর যাত্রী ও পণ্য ভাড়া বৃদ্ধি ও ভর্তুকি তুলে দেওয়ায় ২০১২-১৩ অর্থবছরে রেলের আয় বাড়ে। লোকসান কমে দাঁড়ায় ৮৮১ কোটি টাকায়। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে লোকসান হয় ৮০৩ কোটি টাকা।
কিন্তু গত অর্থবছরে লোকসান বেড়ে প্রায় ৯০০ কোটি টাকায় পৌঁছে গেছে বলে জানান রেল মন্ত্রণালয়ের সচিব ফিরোজ সালাহ উদ্দিন। তিনি গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবছরই রেলের খরচ বাড়ছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৪-১৫ অর্থবছরে খরচ বেড়েছে ৪৫ কোটি টাকা। এখন প্রায় ৯০০ কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে। লোকসান যেন আর না বাড়ে, সে জন্য ভাড়া বাড়ানো হচ্ছে। সচিব বলেন, বাড়ানোর পরও রেলের যে ভাড়া হবে, তা বাসের ভাড়ার অর্ধেক।
এবার ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ২০১৩ সালের শেষ দিকে জাতীয় নির্বাচন-পূর্ববর্তী রাজনৈতিক সহিংসতায় রেলের ৭০ কোটি টাকা ক্ষয়ক্ষতি হয়। নাশকতার ভয়ে এরপর যাত্রী পরিবহন হ্রাস পায়। আবার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা অনেক বাড়ছে। ফলে লোকসান কমানোর স্বার্থে ভাড়া বাড়াতে হবে।
গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর রেলপথ বিভাগ থেকে ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাবিত ছকপত্র পাঠানো হয় রেলপথ মন্ত্রণালয়ে। মন্ত্রণালয় থেকে সেটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়। মাঝে সংসদীয় কমিটিও ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাবে সায় দেয়।
গতকাল রেলভবনে ওয়াই-ফাই ইন্টারনেট সেবা উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক বলেন, রেলে ভাড়া বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে। ৭ দশমিক ৮ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর একটি প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর তা কার্যকর হবে। তেলের দামসহ অন্যান্য খরচের সঙ্গে সমন্বয় রেখে ভাড়া বৃদ্ধির এ প্রক্রিয়া এখন থেকে প্রতিবছরই চলবে।
ভাড়া বৃদ্ধি, নতুন প্রকল্প নিয়ে তোড়জোড় থাকলেও রেলের সেবার মান বাড়ছে না বলে মনে করছেন নিয়মিত যাত্রীরা। ঢাকার একটি পোশাক কারখানার সহকারী ব্যবস্থাপক সাজ্জাদ সাকিব গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, মাসে দুই থেকে তিনবার তিনি ট্রেনে ঢাকা-চট্টগ্রামে যাতায়াত করেন। কিন্তু ছারপোকার যন্ত্রণায় ট্রেনের সিটে বসে থাকা দায়।
আর গতকালই ট্রেনে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসা একটি বেসরকারি ব্যাংকের সহকারী ব্যবস্থাপক সাফায়েত উল্লাহ বলেন, সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের অবস্থা কতটা বেহাল হতে পারে, সেটা ট্রেনে চড়লেই বোঝা যায়। ভেতরটা নোংরায় ভরা, আসন খারাপ, ছারপোকার অত্যাচার, নিরাপত্তার সংকট আর বাথরুম ব্যবহার করা তো প্রায় অসম্ভব।
ভাড়া বাড়লেও সেবা কেন বাড়ছে না, জানতে চাইলে ফিরোজ সালাহ উদ্দিন বলেন, ভাড়া বাড়লে সেবা বাড়ানোর বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়। নতুন কোচ ও ইঞ্জিন রেলে যুক্ত হলে ছারপোকার যন্ত্রণা থাকবে না। যাত্রীরা সেবাও অনেক বেশি পাবে। তিনি বলেন, রেলে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ৪৫টি প্রকল্প চলছে। এগুলো শেষ হলেও যাত্রীরা সুবিধা পাবে।
তবে রেল বিভিন্ন প্রকল্পে হাজার কোটি টাকা খরচ করলেও যাত্রীরা এর শতভাগ সুবিধা পাচ্ছে না। সম্প্রতি চার হাজার কোটি টাকা খরচে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের ১২৫ কিলোমিটার অংশ ডাবল লাইনে (বিদ্যমান লাইনের পাশে আরেকটি নতুন লাইন) উন্নীত করা হলেও ট্রেনের পরিচালন সময় কমেনি। ঢাকা চট্টগ্রামের মধ্যে চলাচলকারী সুবর্ণ এক্সপ্রেসের গতি ১০ কিলোমিটারের মতো কমেছে।
এর কারণ হিসেবে রেল কর্মকর্তা বলছেন, কোচ ও ইঞ্জিনগুলো ২০-৩০ বছরের পুরোনো। এগুলো যে এখনো চলছে, সেটাই বেশি। রেলসচিবও একই দাবি করলেন। তিনি বলেন, নতুন ইঞ্জিন ও কোচ আনার প্রক্রিয়া চলছে। চলতি বছর ভারত থেকে ১২০টি এবং ইন্দোনেশিয়া থেকে ১৫০টি নতুন কোচ আসবে। এ ছাড়া ১০টি নতুন ইঞ্জিন আসবে। এগুলো যুক্ত হলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।