চানখাঁরপুল মোড় থেকে নাজিমুদ্দিন রোড ধরে কয়েক পা এগোলেই পশ্চিমের সরু গলির দুপাশে বাড়ির কার্নিশ আর দোকানপাটের সাইনবোর্ডের পাশে উড়ছে তিনকোনা কালো নিশান। তবে নিশান, পাকপাঞ্জা নিয়ে কালো-সবুজ পোশাক পরে ভেস্তা-কাসেদদের (মিছিলের সামনে থাকেন) সড়কে সড়কে ছোটাছুটি করতে দেখা যাচ্ছে না। আর পথের পাশে মেলাও বসেনি। যদিও আগামীকাল রোববার পবিত্র আশুরা।
এই গলিতেই ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রাচীন নিদর্শন হোসেনি দালান ইমামবাড়া। করোনা সংক্রমণের কারণে এবার ইমামবাড়ার বাইরে মহররমের কোনো আয়োজনের অনুমতি নেই। ভেতরের চত্বরেই ইমামভক্তরা সমবেত হয়ে পয়লা মহররম থেকে এবার ‘হায় হোসেন! হায় হোসেন!’ বলে আশুরার মাতম, মর্সিয়া করছেন।
হোসেনি দালান ইমামবাড়ার আয়তন প্রায় ছয় বিঘা। উত্তরে প্রধান ফটকের সামনে বসানো হয়েছে করোনা প্রতিরোধক বায়োসিকিউরিটি টানেল। ইমামবাড়ায় যেতে হচ্ছে তার ভেতর দিয়ে। সামনে খোলা মাঠ। পশ্চিমে কবরস্থানে লাগানো ফুলগাছে মৌসুমি ফুল ফুটে আছে। ভক্তরা মাঠেই সমবেত হয়ে এবার মাতম, মিছিল করছেন। ইমামবাড়ায় নতুন সাদা রং করা হয়েছে। সামনের থামগুলোতে নীল রঙের টাইলসের ওপর ফুলেল নকশায় পবিত্র কোরআনের আয়াত খচিত। ভেতরে রুপা, কাঠ, জরি ও অন্যান্য ধাতবে নির্মিত পাশাপাশি দুটি তাজিয়া। ভবনের অপর পাশে পুকুর, তাতে সাঁতার দিচ্ছে হাঁসের দল। ভবনটি নির্মিত হয়েছিল হিজরির ১০৫২ সন অনুসারে ১৬৪২ খ্রিষ্টাব্দে।
মোগল সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজা তখন বাংলার সুবাদার। তাঁর প্রিয়ভাজন সৈয়দ মীর মুরাদ নামের এক নৌ সেনাপতি হোসেনি দালান ইমামবাড়াটি নির্মাণ করেছিলেন। ইমামবাড়ার দেয়ালে যুক্ত শিলালিপি থেকে এর প্রতিষ্ঠার পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায় বলে প্রত্নতত্ত্ববিদ আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া তাঁর ‘বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ’ বইতে উল্লেখ করেছেন। এখন যে ইমামবাড়াটি রয়েছে, সেটি অবশ্য মীর মুরাদ নির্মিত প্রথম ইমামবাড়া নয়। প্রথম ইমামবাড়াটি এত বড়ও ছিল না। ঢাকার নায়েব নাজিমেরা দুই দাফায় সেটি সংস্কার করেন। পরে ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ইমামবাড়া ভবনটি ভেঙে যায়। ঢাকার নবাব খাজা আহসানুল্লাহ নতুন করে এটি নির্মাণ করেন। ভেতরের তাজিয়াটিও ওই সময় তৈরি করা হয়েছিল। ইরান সরকারের আর্থিক সহায়তায় ইরানি স্থপতিদের তত্ত্বাবধানে সর্বশেষ ২০১১ সালে ইমামাবাড়া ভবন, পুকুর ও পুরো চত্বরে ব্যাপক সংস্কার করা হয়।
বাংলাপিডিয়া অনুসারে শাহ সুজার সময় এখানে শিয়া মুসলিমদের প্রভাব বেড়ে ওঠে। ঢাকার নায়েব নাজিমদের অধিকাংশই ছিলেন শিয়া। তাঁরা অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে মহররম মাসের শুরু থেকে ১০ তারিখ আশুরা পর্যন্ত মিছিল, মার্সিয়া, মেলাসহ নানা আয়োজন করতেন। ঢাকার মহররমের মিছিল ছিল খুবই বিখ্যাত। মহররম মাসের শুরু থেকেই আশুরার শোক পালনের কার্যক্রম শুরু হলেও এর মূল আয়োজন শুরু হয় ৫ মহররম থেকে। এই দিন সবুজ রঙের পোশাক পরা ভেস্তারা মিছিল করেন। ষষ্ঠ দিনে ভেস্তা ও কাসেদরা তাঁদের লাঠিগুলো দালান চত্বরে বিশেষভাবে আড়াআড়ি করে রেখে দেন। জ্বালানো হয় মোমবাতি। সপ্তম দিনে হোসেনি দালানে আলোকসজ্জা করা হয় এবং বের হয় ‘আলম জুলুশ’। বিকেল থেকে মর্সিয়া গান চলতে থাকে। মহররমের মূল মিছিল শুরু হয় মহররমের ৮ তারিখ থেকে। এই মিছিলগুলোর আলাদা নামও আছে। ৮ মহররমের মিছিলের নাম ‘তুগ গাস্ত’ এরপর ‘গাওহারা গাস্ত’, শেষ দিনে ‘মঞ্জিল গাস্ত’—যেটি এখন ‘তাজিয়া মিছিল’ নামেই পরিচিত।
ঢাকার মহররমের মিছিলের সবচেয়ে পুরোনো বর্ণনার উল্লেখ করেছেন মুনতাসীর মামুন তাঁর ‘ঢাকা: স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী’র দ্বিতীয় খণ্ডে। ১৮৫০ সালে কলকাতার ‘রস সাগর’ পত্রিকায় রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, ৮ মহররমের তুগ গাস্ত মিছিলে ‘বহুসংখ্যক পতাকা, হাতি ঘোড়া প্রভৃতি লইয়া মান্য মোগলরা চকের চতুর্দ্দিকে বেড়াইয়া পুন উক্ত মসজিদে গমন করেন।’ হাতি ঘোড়া ছাড়াও মহররমের মিছিলের সামনে থাকত পাকপাঞ্জাখচিত আলমবাহীদের (নিশানবাহী) দল, তাদের পেছনে বাদক, লাঠি ও তলোয়ার ঘোরাতে ঘোরাতে চলত পারদর্শীদের দল। তারপর দুলদুল ঘোড়াসহ অশ্বারোহীদের দল, বিবির ডোলা, তাজিয়া এবং মর্সিয়ার দল চলত মাতম করে। হোসেনি দালান থেকে মিছিল বের হয়ে বকশীবাজার, উর্দু রোড, বেগম বাজার, চকবাজার ঘুরে আজিমপুরের কারবালায় গিয়ে লেকে তাজিয়া বিসর্জন দেওয়া হতো।
মহররমের এই আয়োজনের মূল উদ্যোক্তা শিয়ারা, তবে সুন্নিরাও এতে অংশ নিত। মিছিল আর মেলা ছিল মহররমের প্রধান আকর্ষণ। খুব সুন্দর করে শৈশবে দেখা মহররমের মিছিল ও মেলার বিশদ বিবরণ দিয়ে গেছেন কবি শামসুর রাহমান তাঁর ‘স্মৃতির শহর’ বইতে: ‘মহররমের মিছিল সবচেয়ে ভালো লাগত চকে। মাঝরাতের মিছিল। নানির সঙ্গে যেতাম চকবাজারের একটা বাড়িতে রাত্তিরে মিছিল দেখব বলে। নানি বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিতেন আর আমি মিছিলের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঝিমুতাম।...ঘুম ভাঙত নানির ঝঁকুনিতে। ... চোখের সামনে ঝলমলে মিছিল। আলম বরদার, আশা বরদার, কালো কাপড়ে ঢাকা বিবিকা ডোলা—একে একে সবকিছু চোখের সামনে। আমার চোখ লুট করতে শুরু করে সিল্কের নিশান, লাঠির ঠোকাঠুকি, তলোয়ারের ঝলসানি, আগুনের চরকি। ফাঁকে ফাঁকে শোনা যায় ভেস্তাদের “এক নারা, দো নারা, বোলো বোলো ভে—স্তা।’”
সেসব দিন এখন আর নেই। গত শতকের ষাট দশকের পর থেকেই ঢাকায় মহররমের মিছিলের জৌলুশ কমে যায়। মেলাও আর আগের মতো জমজমাট হয় না। ২০১৫ সালে ইমামবাড়ায় আশুরার মিছিলে বোমা হামলার পর নিরাপত্তা নিয়ে কড়াকড়ি আরোপ করায় মিছিলের সেই স্বতঃস্ফূর্ততাও হারিয়ে যায়। আর এ বছর করোনা সংক্রমণের কারণে মিছিল করার অনুমতিই নেই। হোসেনি দালান ইমামবাড়ার তত্ত্বাবধায়ক এম এম ফিরোজ হোসেন বললেন, করোনার কারণে কর্মসূচি কিছু সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। আশুরার দিনে ইমামবাড়া চত্বরেই সকাল ১০টা, সন্ধ্যা ৭টা ও রাত ১০টায় তিনটি মিছিল হবে। এ ছাড়া স্বাস্থ্যবিধি মেনে বয়ান ও মর্সিয়া হবে আগের মতোই।
কারবালার প্রান্তরে ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠা করতে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রা.) সপরিবার জীবন উৎসর্গ করে যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন, মানুষের মনে সেই বিয়োগান্ত ঘটনা শোক ও অসত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রেরণা হয়ে আছে চিরন্তন।