এবার আরও জমবে ভার্চ্যুয়াল পশুর হাট
কুষ্টিয়ার সদর উপজেলার আইলচড়া ইউনিয়নের বাগডাঙা গ্রাম। প্রতিবছর কোরবানির ঈদের আগে তিন শতাধিক গরু নিয়ে খামারিরা রাজধানী ঢাকায় পাড়ি দেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে খামারিরা ঢাকার পশুর হাটে গিয়ে সেই ঝুঁকি নিতে চাইছেন না। গ্রাম থেকে গরু বিক্রির চেষ্টায় আছেন বাগডাঙার খামারি মো. ফারুক। খামারিরা এলাকার বাইরে না গেলে কোরবানির হাটে পশুর সরবরাহ কম থাকতে পারে। তাই এবার কোরবানির ঈদে ক্রেতা-বিক্রেতা অনেকেরই ভরসাস্থল হতে যাচ্ছে ভার্চ্যুয়াল পশুর হাট।
ভার্চ্যুয়াল পশুর হাট একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম। যেখানে অনলাইনে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে কোরবানির পশুর ক্রেতা ও বিক্রেতারা একসঙ্গে মিলিত হবেন। বিক্রেতা গরু, ছাগল বা কোরবানি উপযুক্ত পশুর স্থিরচিত্র বা ভিডিও দেখাবেন। গরুর দাম, বয়স, ওজন, কয়টা দাঁত রয়েছে, কোথা থেকে আনা হয়েছে, এমন সব তথ্য থাকবে। কোরবানির হাটের গিয়ে ক্রেতা যেভাবে গরু যাচাই-বাছাই করে থাকেন, ঠিক সেভাবেই দেখা যাবে। পছন্দ হলে ক্রেতা গরু কিনে নিতে পারবেন। দাম ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডে পরিশোধ করা যাবে। ক্রেতা যেখানে চাইবেন, সেখানেই গরু পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
ভার্চ্যুয়াল হাটের কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে: কোরবানির ঈদ সামনে রেখে পশুর হাটের কার্যক্রম শুরু করেছে খামার-ই লিমিটেড নামে একটি স্টার্ট আপ কোম্পানি। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) থেকে সদ্য পাস করা চারজন ইঞ্জিনিয়ার আবদুল্লাহ আবিয়াদ, শাহরুখ হোসাইন, হামিদ হাসান ও দীপ্ত সাহা এটি প্রতিষ্ঠা করেন। দীপ্ত সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৯ সালে লাইভ স্টকে (গবাদিপশু) প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে খামারিদের জীবন–জীবিকাকে সহজ করতে এই কোম্পানির যাত্রা শুরু করি। ২০২০ সালে এই কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে টেলিকম কোম্পানি রবি, আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠান আইডিএলসি এবং টেকনোলজি প্রতিষ্ঠান এসবিকে টেক ভেঞ্চার। পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের আইসিটি ডিভিশনের আওতাধীন স্টার্ট আপ বাংলাদেশ এই উদ্যোগে সহায়তা করে।
দীপ্ত সাহা বলেন, ‘রাজধানী ঢাকার বাড্ডায় আমরা চারজন খামার গড়ে সুযোগ খুঁজতে থাকি যে কীভাবে ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে খামারিদের সমস্যা সমাধান করা যায়। এই লক্ষ্যে এবার করোনা পরিস্থিতিতে আমরা অনলাইন হাট নিয়ে এসেছি। যার মাধ্যমে সরাসরি খামারি ও ক্রেতার মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন হবে। দালালমুক্ত পরিবেশে খামারি গরুর ন্যায্য দাম পাবেন। ভোক্তাও খামারির কাছ থেকে দেখেশুনে ভালো ও পছন্দের কোরবানির গরুসহ অন্যান্য পশু বেচা-কেনা করতে পারেন। এরই মধ্যে ১৫০টি গরু এই হাটে চলে এসেছে। আগামী জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে এর কার্যক্রম শুরু হবে।’
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের আগে কয়েক বছর ধরে অনলাইনে, বিশেষ করে কোরবানির পশু বেচাকেনা চলছিল। অনেকে ব্যক্তি উদ্যোগে, অনেক বড় খামারি ফেসবুকে লাইভওয়েটে কোরবানির পশু বিক্রি করতেন। তবে করোনার ঝুঁকি কারণে এবার এর চাহিদা বা কদর অনেকটাই বাড়তে পারে বলে মনে করছেন খামার–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁদের মতে, করোনার কারণে মানুষের কোরবানি দেওয়ার মতো আর্থিক সংগতি কমে গেছে। প্রতিবছর কোরবানির ঈদে বড় বা একাধিক গরু বা পশু যাঁরা কোরবানি দিতেন, তাঁরা ছোট গরুর দিকে ঝুঁকবেন।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে দেশে কোরবানিযোগ্য গবাদিপশুর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ১৮ লাখ ছিল। কোরবানিযোগ্য ৪৫ লাখ ৮২ হাজার গরু-মহিষ, ৭২ লাখ ছাগল-ভেড়া এবং ৬ হাজার ৫৬৩টি অন্যান্য পশুর ছিল। গতবার ঈদুল আজহায় ১ কোটি ১০ লাখ পশুর কোরবানি হয়ে ছিল। এর আগের বছর ২০১৮ সালে ঈদে কোরবানিযোগ্য গবাদিপশুর মোট সংখ্যা ছিল ১ কোটি ১৫ লাখ এবং কোরবানি হয়েছিল ১ কোটি ৫ লাখের মতো।
এবার কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা আরও বেড়ে গেছে বলে জানান বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাহ ইমরান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে চার মাস ধরে মাংস বিক্রেতাদেরও বিক্রি কমে গেছে। অবিক্রীত গরু-ছাগলও কোরবানির ঈদে যুক্ত হবে। করোনা পরিস্থিতি চলতে থাকলে হাটেও ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগম কম হতে পারে। আর্থিক মন্দা, করোনায় স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিসহ নানা কারণে অন্যান্য বারের তুলনায় এবারের কোরবানি ২০ শতাংশের মতো কম হবে। তাই ক্রেতাদের বড় একটি অংশ অনলাইনে গিয়ে পশু কিনতে যেতে পারেন।
শাহ ইমরান বলেন, অনেক বড় খামারি কোরবানির গরু বা অন্যান্য পশুর মাংস ঈদের দিন প্রক্রিয়াজাত করে ক্রেতার বাড়ি পৌঁছে দেবেন। এই উদ্যোগও চলছে।
করোনার কারণে এবার কোরবানির ঈদে অনেক কম গবাদিপশু বিক্রি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বাংলাদেশ মাংস বিক্রেতা সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কোরবানির সঙ্গে একটি রাজনৈতিক উত্তাপ থাকে। এখন দেশে কোনো ধরনের নির্বাচন নেই। তা ছাড়া করোনার কারণে রাজনীতিবিদ বা সমাজসেবক বা বিত্তবানের খাদ্যসহায়তায় অর্থ ব্যয় করেছেন। কোরবানির মাংস বিতরণে জনসমাগমের বিষয়টিও থাকে। করোনার কারণে সেই ঝুঁকি অনেকেই নিতে চাইবেন না। তাই কোরবানির ঈদে পশুর চাহিদা কমবে। দাম না পাওয়ার আশঙ্কায় খামারিরাও হাটমুখী হবেন না। নিজ এলাকা থেকেই পশু বিক্রির চেষ্টা করবেন তাঁরা। ক্রেতাদের অনেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে অনলাইনে গরু কিনতে চাইবেন।