করোনা সংক্রমণের পাঁচ মাসেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজকর্মে গতি আসেনি। উল্টো সাধারণ মানুষ থেকে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ প্রায় সবারই সমালোচনা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। বিশেষজ্ঞ কমিটি ও টাস্কফোর্স গঠন এবং প্রায় প্রতিদিন এক বা একাধিক প্রজ্ঞাপন জারি ছাড়া মাঠপর্যায়ে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে দৃশ্যমান পরিবর্তন নেই।
গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে। আজ ৮ আগস্ট পর্যন্ত পাঁচ মাসের চিত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ সবাই কোভিড পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানোর কথা বললেও বাস্তবে তা ক্রমাগত কমেছে। সময়মতো মিলছে না পরীক্ষার রিপোর্ট। পাঁচ থেকে সাত দিন অপেক্ষার ভূরি ভূরি নজির রয়েছে। এমনকি রিপোর্টের জন্য ১৪ দিন অপেক্ষারও উদাহরণ আছে।
অন্যদিকে হাসপাতালে গেলে জীবন ঝুঁকিতে পড়বে, এমন আশঙ্কায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা হাসপাতালে যেতে চাইছেন না। কোভিড চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোর শয্যা ফাঁকা পড়ে আছে। অথচ এসব হাসপাতালের জন্য মাসে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে সরকার।
স্বাস্থ্যবিধি মানতে নানা রকম আদেশ-নির্দেশ জারি হলেও হাটবাজার, রাস্তাঘাটসহ জনাকীর্ণ স্থানগুলোতে এখনো প্রায় অর্ধেক মানুষ মাস্ক ব্যবহার করছেন না, মেনে চলছেন না সামাজিক দূরত্ব। এরই মধ্যে কাল রোববার থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাদে মূলত সব ধরনের অফিস-আদালত চালুসহ স্বাভাবিক জীবনযাত্রা শুরু হতে যাচ্ছে।
সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা কোভিড নিয়ন্ত্রণে সফলতার দাবি করলেও জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটির সর্বশেষ তথ্য, আক্রান্তের সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ১৫তম, মৃতের দিক থেকে ২৯তম। ইতালিসহ বিশ্বের অনেক দেশ তিন মাসের মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে, বাংলাদেশে পাঁচ মাসেও সেই লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
করোনা পরীক্ষা কমে যাওয়ার বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরীক্ষা কমেনি, সময়–মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা কমে আসছে। আমাদের মৃত্যুহারও অনেক কম। তা ছাড়া পরীক্ষা করাতে লোকের আগ্রহ কমে গেছে।’
করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজকর্মে সন্তুষ্ট নয় চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)। সংগঠনের মহাসচিব অধ্যাপক মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, করোনা মোকাবিলায় করণীয় সম্পর্কে মন্ত্রণালয়ের ভাবনা কম, ভাবনা নেই চিকিৎসকদের সুরক্ষা নিয়েও। তিনি বলেন, শুরু থেকে চিকিৎসকেরা খুবই বিরক্ত ছিলেন। তাঁদের ব্যক্তিগত পিপিইর নামে রেইনকোট পরানো হয়েছে। ওটা পরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘামে ভিজে চিকিৎসকেরা দায়িত্ব পালন করেছেন। নকল এন-৯৫ মাস্ক দেওয়া হয়েছে।
বিএমএর মহাসচিব বলেন, ‘চিকিৎসকদের থাকার জায়গা নিয়ে নানা রকম জটিলতা সৃষ্টি করা হয়েছে। এসব নিয়ে কথা বলায় কয়েকজন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এখন বলা হচ্ছে, হোটেলে থাকার ব্যবস্থা না করে তাঁদের ভাতা দেওয়া হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই সিদ্ধান্ত আমরা মানি না।’
অভিযান বন্ধ নিয়ে প্রশ্ন
দেশের এই অতিমারির সময়েও যে প্রতারণা ও জালিয়াতি হতে পারে, সেই নজির স্থাপন হয়েছে বাংলাদেশে। মাস্ক কেলেঙ্কারি, ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী (পিপিই) কেনায় দুর্নীতি, কোভিড পরীক্ষার নামে জালিয়াতি, অনুমোদন বা লাইসেন্স ছাড়া হাসপাতাল পরিচালনা, যোগ্যতা না থাকলেও পাঁচটি হাসপাতালকে কোভিড পরীক্ষা ও চিকিৎসার অনুমতি দেওয়া এবং পরে তা বাতিল—একের পর এক এসব ঘটনায় স্বাস্থ্য খাত সমালোচনার চূড়ায় ওঠে। একপর্যায়ে রিজেন্ট হাসপাতাল এবং জিকেজির কেলেঙ্কারির ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শক্ত অবস্থান নেয়। কিন্তু এরপরই ‘লোম বাছতে কম্বল’ শেষ হওয়ার উপক্রম হয়। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমান সাংসদ মহীউদ্দীন খান আলমগীরের নেতৃত্বাধীন ৫০০ শয্যার গাজীপুর সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল অনুমোদন ছাড়াই অর্ধযুগ ধরে চলছে। গণমাধ্যমে এসব তথ্য প্রকাশ হওয়ার প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নড়েচড়ে বসে।
গত মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, হাসপাতাল-ক্লিনিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে চিকিৎসা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এ নিয়ে হাসপাতালগুলোতে চাপা অসন্তোষ বিরাজ করছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠির পর প্রশ্ন উঠেছে, কেউ অন্যায় করলে, প্রতারণা বা জালিয়াতি করলে বা সরকারের শর্ত ভঙ্গ করলে বা অনুমোদন ছাড়া হাসপাতাল চালালে ছাড় দিতে হবে কেন? এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাসপাতালের বিষয়ে কোনো অভিযোগ থাকলে আমাদের পরামর্শ নিয়ে সেখানে যেতে হবে। অভিযানে গিয়ে চিকিৎসকদের হাতকড়া পরানো হয়, অপমান করা হয়, এটা ঠিক নয়।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কাছে কোনো তথ্য থাকলে আমরা অবশ্যই অভিযান করব। তবে আমরা তাদের জানাব। তারা চাইলে আমাদের বাহিনীর সঙ্গে থাকতে পারে। অভিযান বন্ধ হবে না।’
হাসপাতালে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে পূর্বানুমতি কার স্বার্থে? এমন প্রশ্ন তুলেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। গতকাল এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, স্বাস্থ্য খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি প্রকাশের যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল, তা প্রতিহত করার চেষ্টা চলছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্নমত জানিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও। তাঁরা বলছেন, অন্যায় করলে যে কারও হাতে হাতকড়া পড়তে পারে। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক এম আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার কাছে এসে বিভিন্ন জন মন্ত্রণালয়ের এসব সমস্যার কথা বলছে। তবে আমি হাসপাতাল বা অভিযান দুটোই বন্ধ করার বিরুদ্ধে।’
রদবদলে গতি কতটা বাড়ল
স্বাস্থ্য খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শুধু রদবদল বা পরিবর্তনে স্বাস্থ্য খাতের উন্নতি হবে না। এই খাত মূলত নিয়ন্ত্রণ এবং অনেক ক্ষেত্রে পরিচালনা করে কয়েকটি সিন্ডিকেট। এসব সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত এবং শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকবে।
প্রথম থেকেই এ খাতে কেলেঙ্কারির অভিযোগ ছিল স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে ঘিরে। তাঁকে রেখে স্বাস্থ্যের দুই সচিব, একাধিক অতিরিক্ত সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও কয়েকজন পরিচালককে নিজ পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এসব রদবদল নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হলেও স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে তা খুব একটা প্রভাব ফেলেনি।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে এত রদবদল হলো, এখন মন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিত কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘মন্ত্রী তো ভালো কাজ করছেন। কেন তাঁর পরিবর্তন হবে বা কেন তিনি পদত্যাগ করবেন?’
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজে গতি আসেনি, এমন কথা মানতে নারাজ স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, বাংলাদেশের কেউ এ মুহূর্তে স্বাস্থ্যসেবার বাইরে নেই। এ ছাড়া পরিস্থিতির কারণে আমাদের দ্রুত নানা রকম সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।
মন্ত্রীর এই বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন অনেকেই। বিএমএর মহাসচিব ইহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, মন্ত্রণালয় যখন যা ইচ্ছে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, বদলি করছে। এতে মন্ত্রণালয়ের অদক্ষতা, অস্থিরতাই দৃশ্যমান হচ্ছে।
কাজের চেয়ে কথা বেশি
গত পাঁচ মাসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে কাজের চেয়ে কথা বেশি লক্ষ করা যায়। সরকারের একাধিক মন্ত্রী বক্তৃতা-বিবৃতিতে করোনা মোকাবিলায় সরকার সফল বলে দাবি করে আসছে। প্রকৃতপক্ষে এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় শুরু থেকেই যেসব বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতা ছিল, তা কাটেনি।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা মোকাবিলার প্রস্তুতির জন্য বাংলাদেশ যথেষ্ট সময় পেয়েছিল। কিন্তু সেই সময়টা কাজে লাগাতে পারেনি। এখনো প্রস্তুতির ঘাটতি ও সমন্বয়হীনতার অভিযোগ আছে।
স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন-সম্পর্কিত জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশিদ-ই-মাহবুব প্রথম আলোকে বলেন, মন্ত্রণালয় তো জানেই না, কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক। তারা সিদ্ধান্ত নেবে কী করে! তাদের কাজের গতিই বা আসবে কোথা থেকে। তিনি মনে করেন, অনেক দিন ধরেই স্বাস্থ্য খাতে সমন্বয়হীনতা চলছে। এখন চলছে অস্থিরতা। কারিগরি কমিটিগুলোর পরামর্শ না নিয়ে, না বুঝে বা আলোচনা না করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়। স্বাস্থ্য খাতে যাঁরা আসেন, তাঁরা নিজেদের স্বার্থ দেখেন।