নিম্নবিত্তের মানুষ থেকে মধ্যম আয়ের পরিবার—সবার যেন হাত পুড়ছে বাজারে গিয়ে। চাল, ডাল ও তেলের দামে অস্বস্তি আগে থেকেই ছিল; এ তালিকায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে পেঁয়াজ, আটা, ময়দা, মুরগি, ডিমসহ আরও কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। বেড়েছে রান্নার গ্যাস, সাবান ও টুথপেস্টের মতো নিত্যব্যবহার্য সামগ্রীর দামও।
সব মিলিয়ে যখন সংসার চালানোই দায়, তখন দুঃসংবাদ আরও আছে। বিপণনকারী কোম্পানিগুলো ভোজ্যতেল ও চিনির দাম আরও বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছেই। জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দামও বাড়তি।
এই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও সরকারের ভূমিকা সীমিতই থাকছে। তেল-চিনিতে কর ছাড় দেওয়ার দাবি উঠেছিল, তাতে সাড়া পাওয়া যায়নি। সরকারিভাবে কম দামে চাল, ডাল, তেল ও চিনি বিক্রির কার্যক্রমের পরিসরও চাহিদার তুলনায় সীমিত থাকছে।
অথচ এখন সরকারের চাল ও নিত্যপণ্য বিক্রির ভ্রাম্যমাণ কেন্দ্রের সামনে সীমিত আয়ের মানুষের ভিড় সাম্প্রতিক কালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এর চেয়ে বেশি ভিড় দেখা যেত বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। তখন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়েছিল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজধানীর কাজীপাড়ার এক আসবাব ব্যবসায়ী জানান, তিনি এখন সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ট্রাকের অপেক্ষায় থাকেন। কয়েক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও তেল-চিনি কিনে বাসায় ফেরেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সবকিছুর দাম এখন চড়া। বাজারে এক কেজি চালের দাম ৬০ টাকা। এক লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১৫০ টাকা। কিছুদিন আগেও এক কেজি ব্রয়লার মুরগি ১২০ টাকায় কেনা যেত, এখন সেটা ১৭৫ টাকা। তিনি বলেন, দুই বছর ধরে ব্যবসার অবস্থা ভালো নয়। এর মধ্যে সংসারের ব্যয় বাড়ছেই।
করোনাকালে দাম কতটা বাড়ল
দেশে গত বছরের ৮ মার্চ করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে। তখন থেকে শুরু হয় আতঙ্কের কেনাকাটা, যাকে বলা হয় ‘প্যানিক বায়িং’। বাড়তে থাকে দাম।
টিসিবির ২০২০ সালের ১ মার্চ ও গত বৃহস্পতিবারের বাজারদরের তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সে সময়ের তুলনায় এখন মোটা চালের গড় দাম সাড়ে ৩১ শতাংশ, খোলা আটার ২০, খোলা ময়দার ৩৩, এক লিটারের সয়াবিন তেলের বোতল ৪৩, চিনির ১৯, মোটা দানার মসুর ডাল ৩০ ও গুঁড়া দুধের ১৩ শতাংশ বেশি।
ভোজ্যতেলের উদাহরণটি দেওয়া যাক। পাঁচ সদস্যের একটি পরিবারে মোটামুটি পাঁচ লিটারের এক বোতল সয়াবিন তেল প্রয়োজন হয়। গত বছর অক্টোবরে এই পরিমাণ তেলের দাম ছিল ৫০৫ টাকা। এখন তা কিনতে ৭০০ টাকা লাগে। বোতলের গায়ে মুদ্রিত দর ব্র্যান্ডভেদে ৭২৮ থেকে ৭৪৮ টাকা। ফলে দেখা যাচ্ছে, একটি পরিবারে মাসে ২০০ টাকার মতো বাড়তি লাগছে শুধু ভোজ্যতেল কিনতেই।
বাজারে দুই সপ্তাহে বেড়েছে পেঁয়াজ, মসুর ডাল, ব্রয়লার মুরগি, ডিম ও সবজির দাম। পেঁয়াজের দাম মোটামুটি দ্বিগুণ হয়ে গেছে। যে দেশি পেঁয়াজ ৪০ টাকা কেজিতে কেনা যেত, তা কিনতে এখন ৮০ টাকা লাগছে। কোনো উৎসব বা উপলক্ষ নেই, তবু ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৮০ টাকা ছুঁয়েছে, যা সাধারণত ১২০ থেকে ১৪০ টাকার মধ্যে থাকে।
এ বছর ইলিশের দামও কমেনি বললেই চলে। ৪ অক্টোবর থেকে ইলিশ ধরা বন্ধ হওয়ার পর বাজারে অন্য মাছের কদর বেড়েছে, দাম চড়া। সবজি রান্নার জন্য সামান্য ছোট চিংড়ি কিনতে প্রতি কেজির দাম পড়ছে ৫৫০ টাকা। অবশ্য সবজি কেনার জো কই! বেশির ভাগের প্রতি কেজির দাম ৫০ থেকে ৬০ টাকা।
শুধু যে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে, তা নয়। বেড়েছে নিত্যব্যবহার্য বিভিন্ন পণ্যের দাম। যেমন মাস তিনেক আগে বাজারে সুপরিচিত একটি ব্র্যান্ডের ১০০ গ্রাম ওজনের একটি সাবানের দাম ছিল ৩৫ টাকা। সেটা এখন ৪০ টাকায় বিক্রি করছে তারা। বেড়েছে ডিটারজেন্ট, টুথপেস্ট, নারকেল তেল, শৌচাগারে ব্যবহার করা টিস্যুসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম। সুপরিচিত আরেকটি ব্র্যান্ডের এক প্যাকেট টিস্যুর দাম ছিল ১৭ টাকা, যা এখন ২০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। মানে হলো, টিস্যুর পেছনে একটি পরিবারের মাসিক ব্যয় ১৮ শতাংশ বেড়ে গেছে।
কেন এই মূল্যবৃদ্ধি
বেশির ভাগ নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্য ও ব্যবহার্য পণ্যের দাম বাড়ার একটা কারণ বিশ্ববাজার। আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেল, গম, চিনি, ডাল, গুঁড়া দুধ ও শিল্পের বিভিন্ন কাঁচামালের দাম বাড়তি। সঙ্গে বেড়েছে জাহাজভাড়া। এই বৃদ্ধির প্রবণতা শুরু হয়েছিল এ বছরের শুরু থেকেই।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) খাদ্য মূল্যসূচক প্রতিবেদন বলছে, গত মে মাসে বিশ্ববাজারে খাদ্যের দাম বেড়েছিল ৪ দশমিক ৮ শতাংশ, যা ২০১০ সালের পর মাসিক বৃদ্ধির হারে সর্বোচ্চ। খাদ্য মূল্যসূচক এখন ২০১১ সালের পর সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০০৭ থেকে ২০০৮ এবং ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বিশ্ববাজারে খাদ্যের দাম অনেক বেশি ছিল। সেই সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। রপ্তানিকারক দেশগুলো নিজেদের বাজার সামাল দিতে খাদ্যপণ্যের বাণিজ্যে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে।
বাজার বিশ্লেষকেরা এবারের দাম বাড়ার পেছনে করোনাকালে সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়া, উৎপাদন কমে যাওয়া, জ্বালানি তেলের দাম ও জাহাজভাড়া বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন দেশের মজুতপ্রবণতাকে দায়ী করছেন। দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় করপোরেট প্রতিষ্ঠানের নিত্যব্যবহার্য পণ্য বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে আগামী দিনগুলোতে আরও খারাপ সময় অপেক্ষা করছে।
অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে মূল্যবৃদ্ধির জন্য শুধু বিশ্ববাজারকে দায়ী করা যাবে না। ব্যবসায়ীদের কারসাজিও এ ক্ষেত্রে দায়ী। উদাহরণ হিসেবে তাঁরা পেঁয়াজের দামকে সামনে এনে বলছেন, ভারতে সামান্য দাম বাড়তেই মাত্র দুই সপ্তাহে দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেল কেন?
দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি দারিদ্র্য পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে পারে। মানুষের সহায়তা কতটা দরকার, কী রকম সহায়তা দরকার—এসব নিয়ে সরকারের উচিত একটি পর্যালোচনা করা।
সরকারি কার্যক্রমও সীমিত
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়লে সরকার বাজারে তদারকি বাড়ায়। অনেক সময় কর ছাড় এবং সরকারিভাবে কম দামে বিক্রি বাড়িয়ে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হয়।
টিসিবি এখন দেশজুড়ে দিনে প্রায় সাড়ে চার শ ট্রাকে করে ভোজ্যতেল, চিনি, ডাল ও পেঁয়াজ বিক্রি করছে। কয়েক মাস আগেও পরিমাণ মোটামুটি একই ছিল। গত এপ্রিলে সংস্থাটি চিনি ও সয়াবিন তেলের দাম বাড়িয়েছে। এখন একেকজন গ্রাহককে দুই লিটারের বেশি সয়াবিন তেল দিচ্ছে না, যা আগে পাঁচ লিটার ছিল।
করোনাকালে খাদ্য অধিদপ্তর চাল ও আটা বিক্রির বিস্তৃত কর্মসূচি নিতে পারেনি। এখন তারা বিক্রি বাড়িয়েছে। গত ১ জুলাই থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে চাল ও আটা বিক্রি ৩০ শতাংশ বেড়েছে। তবে এটাকেও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বলছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা বলছেন, সরকার কম দামে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ চাল বিক্রি করলে বাজারে মোটা চালের দাম কমে আসত। এটা আরও বাড়াতে হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা তেল ও চিনির কর কমাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দিয়েছে। বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কর কমানোর চিঠির পর এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া পাইনি।’
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আগামীকাল সোমবার দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি নিয়ে একটি বৈঠক ডেকেছে। এ বৈঠকে কর কমানোর বিষয়ে আলোচনা হবে বলে জানান বাণিজ্যসচিব। তিনি বলেন, পেঁয়াজের শুল্কের বিষয়টিও পর্যালোচনা হচ্ছে। সব নিত্যপণ্য নিয়েই সোমবারের বৈঠকে আলোচনা হবে।
ব্যবসায়ীদের দাবি, প্রতি কেজি চিনিতে এখন ২৮ টাকা ও ভোজ্যতেলে ২০ টাকার মতো কর পড়ছে। যেহেতু পণ্যের দামে কর শতাংশ হারে আদায় হয়, সেহেতু বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে করের পরিমাণও বেড়ে যায়। এদিকে ব্যবসায়ী সূত্র জানায়, সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১১ টাকা বাড়িয়ে ১৬৪ টাকা এবং চিনির দাম কেজিতে ৯ টাকা বাড়িয়ে ৮৪ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব সরকারের কাছে দেওয়া আছে।
বেতন কমেছে, খরচ বেড়েছে
বিউটি পারলারকর্মী সালমা খাতুন স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকেন ঢাকার মোহাম্মদপুরের শের শাহ সুরী সড়কে। তিনি জানান, করোনা পরিস্থিতিতে তাঁর অনেক সহকর্মীর চাকরি চলে গেছে। তাঁর বেতন মাসে ১৮ হাজার টাকা থেকে কমে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৭ হাজারে।
মোহাম্মদপুরের টাউন হল বাজারে গত বৃহস্পতিবার সালমা মুরগি কিনতে গিয়েছিলেন। তখন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাছ ও গরু মাংসের দাম অনেক। সন্তানেরা মাংস খেতে চাইলে ব্রয়লার মুরগি কিনি। এই মুরগির দামও কেজিতে ৪০ টাকা বেড়েছে।’
রাজধানীর মিরপুরের রূপনগর বস্তিতে থাকেন সোহাগ মিয়া। করোনার সময় ব্যক্তিগত গাড়িচালকের চাকরিটি চলে যায়। এখন একটি খাবার হোটেলে সহকারীর কাজ করছেন, বেতন মাসে ছয় হাজার টাকা। তিনি বলেন, ‘বেশির ভাগ সময় ভর্তা-ভাজি দিয়েই ভাত খাই। এখন ভর্তার পেঁয়াজ ও কাঁচা মরিচের অনেক দাম।’
‘সরকারকে আগে স্বীকার করতে হবে’
করোনাকালে দারিদ্র্য পরিস্থিতি কী দাঁড়াল, তা নিয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) কোনো জরিপ নেই। বেসরকারি সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) বলেছিল, দারিদ্র্যের হার প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে (৪২ শতাংশ)। যদিও সরকার তা মেনে নেয়নি। নিজেরাও কোনো জরিপ করেনি। বিবিএস গত বছরের অক্টোবরে এক টেলিফোন জরিপে জানিয়েছিল, মানুষের আয় কমেছে ২০ শতাংশের মতো।
সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি দারিদ্র্য পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে পারে। মানুষের সহায়তা কতটা দরকার, কী রকম সহায়তা দরকার—এসব নিয়ে সরকারের উচিত একটি পর্যালোচনা করা। তার আগে দারিদ্র্য পরিস্থিতির অবনতির বিষয়টি স্বীকার করতে হবে।