জীবনযাত্রার ব্যয়—২
একটি কলা, একটি ডাব, সেই সময়, এই সময়
চাল-ডালের বাইরে বিভিন্ন খাবার ও নিত্যব্যবহার্য পণ্যের বাড়তি দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে সংসারের ব্যয়।
একটি কলা আর একটি বানরুটি—ভাতের বদলে এটাই এখন কারও কারও দুপুরের খাবার। চায়ের দোকানে মাস দু-তিন আগেও যে রুটি ৭ টাকা ছিল, তা এখন ১০ টাকা। আর ‘প্রমাণ সাইজের’ একটি কলা তো ১০ টাকার নিচে কেনাই যায় না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির যে হিসাব করে, তাতে রুটি-কলার দাম বিবেচনায় নেওয়া হয় না। তবে হল বা মেসে কিংবা একাকী জীবন যাঁদের কাটাতে হয়, তাঁরা তো আসলে বানরুটি-ডিম বা কলার বৃত্তেই বন্দী। ভাত রান্নার বদলে ডিম-কলা-রুটির সংস্থানই সহজ, সস্তাও বটে।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) জীবনযাত্রার ব্যয়ের হিসাবে কলার দামকে রেখেছে। তাদের হিসাবে দেখা যায়, ২০০৯ সালে দেশে একটি সাগর কলার গড় দাম ছিল ৫ টাকার কম। ২০২০ সালে সেই কলার গড় দাম ১০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। বেড়েছে ১১০ শতাংশ।
সংসারে চাল, ডাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজ, রসুন এবং মাছ, মাংস, সবজি যেমন কিনতে হয়, তেমনি একটি কলা, একটি ডিম, এক লিটার দুধ, একটি সাবান, একটি দেশলাইয়ের বাড়তি দামও মানুষের ব্যয় বাড়ায়। করোনাকালে, ডেঙ্গুর মৌসুমে ডাব হয়ে যায় রোগীর পথ্য কিংবা প্রচণ্ড গরমে একটা ডাব কিনে খাওয়ার ইচ্ছাও তো হতে পারে। বছরে একটি-দুটি সুতি শাড়ি কিনতে হয়। লুঙ্গি কিনতে হয়। গামছা কিনতে হয়। অথচ পরিস্থিতি এমনই দাঁড়িয়েছে, ভাতের বিকল্পেরও দাম বাড়ছে, শখ তো অনেক দূরের বিষয়।
দিন যাবে, জিনিসপত্রের দাম বাড়বে, মূল্যস্ফীতি বাড়বে, সঙ্গে বাড়বে মানুষের আয়—এটাই হয়ে আসছে। তাহলে কলার দাম দ্বিগুণ হলে অসুবিধা কী, এ প্রশ্ন উঠতেই পারে। সে ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, দেশে ২০১০-১১ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরে জীবনযাত্রার ব্যয় যতটা বেড়েছে, ততটা জাতীয় মজুরি বাড়েনি। বিবিএস বলছে, ২০১০-১১ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত মজুরিসূচক বেড়েছে প্রায় ৮১ শতাংশ। বিপরীতে মূল্যসূচক বেড়েছে ৮৪ শতাংশ। ক্যাবের হিসাবে, ঢাকায় ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দ্রব্যমূল্য বেড়েছে ৯৫ শতাংশ।
ক্যাবের সভাপতি ও সাবেক বাণিজ্যসচিব গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘জিনিসপত্রের দাম বাড়বেই। দেখতে হবে সে অনুযায়ী আয় বেড়েছে কি না। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, কম-বেশি সবারই আয় বেড়েছে, ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। কোভিড-১৯-পরবর্তী সময়ে অনেকের আয় কমেছে। মূল্য পরিস্থিতিও নাজুক হয়ে পড়েছে। কিছু লোক আরও ধনী হয়েছে।’
সময়টাই বৈরী
সময়টা অবশ্য সব দিক থেকেই বৈরী। টানা দুই বছরের কোভিড বিশ্বব্যাপী উৎপাদন কমিয়েছে, বিঘ্নিত করেছে সরবরাহব্যবস্থা। ফলে কয়েক মাস ধরেই বিশ্বব্যাপী বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতি নিয়ে অন্যতম সংবেদনশীল দেশ যুক্তরাষ্ট্রে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতেও মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১ দশমিক ৭ শতাংশ। এক বছর পর সেই মূল্যস্ফীতি এখন ৭ দশমিক ৯ শতাংশ। কেবল যুক্তরাষ্ট্রই নয়, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে সব দেশ। বাংলাদেশও এর দূরে নয়। বিশেষ করে যেখানে বেশির ভাগ ভোগ্যপণ্যই আমদানি করতে হয়। এখানেও বাড়ছে মূল্যস্ফীতি।
নতুন করে মূল্যস্ফীতির চাপে হিমশিম খাচ্ছে দেশের সীমিত আয়ের মানুষ। টিসিবির ট্রাকের সামনে বাড়ছে ভিড়। এর মধ্যে ক্রয়ক্ষমতা বাড়াসহ নীতিনির্ধারকদের নানা ধরনের কথাবার্তা ক্ষোভও তৈরি করছিল। তবে সরকার মানুষের কষ্টকে আমলে নেওয়ার চেষ্টা করছে। ভোজ্যতেলের ওপর ভ্যাট ছাড় দেওয়া হয়েছে। টিসিবির মাধ্যমে পণ্য বিক্রি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এক কোটি পরিবারকে কার্ড দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা দিয়ে তারা সাশ্রয়ী মূল্যে নিত্যপণ্য কেনার সুযোগ পাবে। তবে অনেক কিছুই নির্ভর করছে ইউক্রেন যুদ্ধের ফলাফলসহ বিশ্ব পরিস্থিতির ওপর।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সদস্য শাহ মো. আবু রায়হান আল বেরুনী এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ভ্যাট কমানোর পর ভোজ্যতেলের মূল্য নিয়ে পর্যালোচনা বৈঠক শিগগিরই হবে। তবে এখন নিত্যপণ্যের মূল্য যে কিছুটা বেড়েছে, তা বিশ্ববাজারের কারণে। সরকার দাম কমিয়ে আনতে নানাবিধ পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর সুফল শিগগিরই পাওয়া যাবে।
তখন, এখন
বিবিএসের পরিসংখ্যান বলছে, স্বাধীনতার পরপর দেশে এক হালি সবরি কলার দাম ছিল ৬০ পয়সার মতো। তার মানে, একটি কলা কেনা যেত ১৫ পয়সা দিয়ে। আর এখন ভালো মানের এক হালি সবরি কলার দাম অন্তত ৪০ টাকা।
১৯৭২ সালে ঢাকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কত ছিল, তা জানা যায় ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) ঢাকার বাণিজ্যিক ইতিহাস বই থেকে। এই বইতে ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারস ও সংবাদপত্রকে সূত্র হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ১৯৭২ সালে ঢাকায় চালের দাম ছিল প্রতি মণ ৬৯ টাকার মতো। এখন তা ১ হাজার ৮০০ ঢাকার আশপাশে। মানে হলো, চালের দাম বেড়েছে ২৬ গুণ। আজ থেকে ঠিক ১০০ বছর আগে চালের মণ ছিল ৬ টাকা ৬৩ পয়সা।
১৯৭২ সালে কোন পণ্যের দাম কত ছিল, তা জেনে নেওয়া যাক। লবণের মণ ছিল ১৮ টাকার কিছু বেশি। গম পাওয়া যেত ৩০ টাকা মণ দরে।
ঢাকা চেম্বার অবশ্য কলা, ডাব (নারকেল), দেশলাই অথবা শাড়ি-লুঙ্গির দামের হিসাব দেয়নি। সেটা পাওয়া যায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পুরোনো নথিপত্র ঘেঁটে। সবরি কলার দামটি সেখান থেকেই নেওয়া।
১৯৭২ সালে ডাবের দাম কত ছিল, তা সরাসরি জানা যায় না। তবে বিবিএস নারকেলের দাম উল্লেখ করেছে, যা থেকে ডাবের দামের একটি ধারণা পাওয়া যায়। কারণ, ডাব ও নারকেলের দাম মোটামুটি একই। বিবিএসের হিসাবে, ১৯৭১-৭২ অর্থবছরে একটি নারকেলের দাম ছিল ৭৩ পয়সা। এখন একটি নারকেল কিনতে লাগে ৮০ টাকার মতো।
স্বাধীনতার পরপর দেশে এক সের পেঁয়াজের দাম ছিল ৭৮ পয়সা। দুধের ব্যবসায় তখনো লিটার পদ্ধতির পরিমাপের প্রচলন হয়নি। সের দরেই কেনাবেচা হতো দুধ। দাম ছিল ১ টাকা ৭ পয়সা। চিনি পাওয়া যেত প্রতি সের ২ টাকা ১৩ পয়সায়।
এখন যেমন রান্নার জ্বালানি হিসেবে গ্যাস বেশি ব্যবহৃত হয়, তখন ছিল লাকড়ি। প্রতি মণ গজারির লাকড়ির দাম ছিল ৫ টাকা ১১ পয়সা। এই কাঠে আগুন জ্বালাতে ১০ পয়সা দিয়ে একটি দেশলাই কিনতে হতো। এখন অটো বা স্বয়ংক্রিয়ভাবে জ্বলে ওঠা চুলার যুগে দেশলাইয়ের কদর কমেছে। কিন্তু বাজারে এখনো একেকটি দেশলাই দুই টাকায় বিক্রি হয়।
তখন অনেকে অবশ্য কেরোসিন তেলেও রান্না করতেন। বিশেষ করে মেসে তরুণ-যুবকদের ভরসা ছিল কেরোসিনের স্টোভ (চুলা)। সাদা ২২ আউন্স (৩৪ আউন্সে এক লিটার) কেরোসিন কিনতে হতো ৮৩ পয়সা দিয়ে। এখনকার বাজারে ২২ আউন্স কেরোসিনের দাম ৫২ টাকার মতো। সর্বশেষ গত মাসে সরকার কেরোসিনের দাম প্রতি লিটার ৬৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০ টাকা করেছে।
১৯৮২ সালে কেমন ছিল বাজারদর
ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাব ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। তাদের কাছে সর্বশেষ ১৯৮২ সালে ঢাকায় দ্রব্যমূল্য কত ছিল, সেই তালিকা আছে। এতে দেখা যায়, তখন সরু চালের কেজি ছিল ৯ টাকা ৮৫ পয়সা। খাদ্যশস্যের মধ্যে রেশনের গম প্রতি কেজি ৩ টাকা ৮৯ পয়সা, মসুর ডাল সোয়া ৮ টাকা, সয়াবিন তেল ২৮ টাকা ও পেঁয়াজ প্রায় ৮ টাকা ছিল।
ক্যাব বলছে, ১৯৮২ সালে গরুর দুধের লিটার ছিল ৮ টাকা। ২৩ টাকা কেজিতেই পাওয়া যেত এক কেজি গরুর মাংস। সবজির গড় দাম ছিল কেজি ৫ টাকা ৭৮ পয়সা। লবণের কেজি ছিল ২ টাকা। চিনি পাওয়া যেত ১৪ টাকা কেজিতে।
ক্যাবের হিসাবে, ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ঢাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছিল ১৭৭ শতাংশ। ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বেড়েছে ৭৬ শতাংশের কিছু বেশি। ২০০১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বেড়েছে ৮৭ শতাংশের বেশি। ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ে ঢাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৯২ শতাংশ।
২০০৯-২০২০
ক্যাবের হিসাবে, ২০০৯ সালে ঢাকায় একটি ডাবের দাম ছিল ২২ টাকার মতো। সেটা ২০২০ সালে গড়ে ৭৪ টাকায় বিক্রি হয়। রাজধানীতে এখন একটু বড় হলেই একটি ডাবের দাম চাওয়া হয় ৮০ টাকা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০০ টাকা।
২০১০ সালে যে সুগন্ধি সাবান ২০ টাকা ছিল, সেটা দাঁড়ায় ৪৯ টাকায়। ৩৯০ টাকায় যে সুতি শাড়ি পাওয়া যেত, তা এখন ৭৮০ টাকায় উঠেছে।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে এক কাপ চা পান করবেন, ব্যয় কমপক্ষে ছয় টাকা। চায়ের দোকানিরা বলছেন, ২০০৯ সালে তা তিন টাকার মতো ছিল। ওই বছর খোলা চায়ের কেজি ছিল ১৮৬ টাকা, যা এখন ৪৬৮ টাকা।
২০০৯ সালে একটি ডিম ছিল ৭ টাকা। সেটা ২০২০ সালে ৯ টাকা ছাড়িয়ে যায়। এখনো ডিমের হালি ৩৬ টাকার মতো। আবার প্রশ্ন উঠতে পারে, আয় বাড়ার সঙ্গে দাম বাড়লে অসুবিধা কী? উত্তর হলো, সবার আয় ততটা বাড়ে না, যতটা দাম বাড়ে। সরকারি হিসাবে করোনার আগেও প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল। করোনাকালে দারিদ্র্যের হার ২১ থেকে বেড়ে ৪২ শতাংশ (সাড়ে ছয় কোটির বেশি) হয়েছিল বলে জরিপে উল্লেখ করেছে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান ব্যয়সৃষ্ট মূল্যস্ফীতি তত্ত্ব দিয়ে চাল-ডালের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে একটি কলা, একটি ডাবের দাম বাড়ার সম্পর্ক দেখান। তিনি বলেন, ৩৫ টাকার চাল যদি ডাবওয়ালাকে ৫০ টাকা দিয়ে কিনতে হয়, তাহলে তিনি ডাবের দাম বাড়িয়ে দেবেন। ভোজ্যতেল, ময়দার দাম বাড়লে বাড়বে চায়ের দোকানে বিক্রি হওয়া বানরুটির দাম। সেটা আবার রিকশাভাড়া বাড়িয়ে দেবে। সঙ্গে বাড়বে রিকশায় আরোহীদের ব্যয়। ডিজেলের দামের কারণে সব পণ্যের পরিবহন ব্যয় বাড়ে।
সেলিম রায়হান বলেন, ‘আমরা যেসব পণ্যকে নিত্যপণ্য বলি, তার মধ্যে কলা বা ডাব থাকে না। কিন্তু এগুলো মানুষকে নিত্য কিনতে হয়। বহু আগের চাহিদাকাঠামো ও এখনকার চাহিদাকাঠামো এক নয়।’ তিনি বলেন, অনেকে তো একটি কলা ও একটি বানরুটি খেয়ে দুপুর বা বিকেলের খাবার সারেন। রুটি-কলার দাম বাড়লে তাঁর জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ে।