ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বিভিন্ন স্থাপনা আর অব্যবস্থাপনায় এখন বিপর্যস্ত। এই সবুজ উদ্যানকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা গেলে তা হতো রাজধানীর নাগরিক জীবনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার একটি মনোরম স্থান। উদ্যানের বর্তমান অবস্থা নিয়ে লিখেছেন আশীষ-উর-রহমান এবং ছবি তুলেছেন জাহিদুল করিম
এ যেন সবার চোখের সামনে মৃত্যু। সে মৃত্যুও স্বাভাবিক নয়। বলা ভালো, চলছে মেরে ফেলার প্রক্রিয়া। রাজধানী ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে নিবিড় সবুজে ঢাকা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানটিকে কার্যত হত্যাই করা হচ্ছে।রেসকোর্স নামের এ ঐতিহাসিক ময়দানকে স্বাধীনতার পরপরই বৃক্ষরোপণের মধ্য দিয়ে বদলে ফেলা হয়েছিল। শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের বরাবরের চেষ্টাই ছিল শহরের মাঠগুলোকে নানা স্থাপনায় ভরিয়ে ফেলা। উদ্দেশ্য জনসভা ঠেকানো। পঞ্চাশের দশকে ঢাকায় বড় বড় রাজনৈতিক সভা হয়েছে আরমানিটোলা ময়দানে। এরপর ষাটের দশকে জনসভা হয়েছে পল্টন মাঠ ও রেসকোর্সে। পল্টন মাঠে স্বাধীনতার পর গড়ে তোলা হয়েছে ফুটবল ও হকি স্টেডিয়াম, সুইমিংপুল, মার্কেট, মসজিদ এসব স্থাপনা।রেসকোর্সের নাম বদলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নামকরণ করে সেখানে বৃক্ষ রোপণ করা হয়েছিল। মাঠটি হারিয়ে গেলেও দিনে দিনে গাছগুলো বড় হয়ে নিবিড় সবুজের সমারোহে যান্ত্রিক নগরে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার মতো পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু নানা রকমের স্থাপনায় সেই উদ্যানটিও এখন মৃত্যুপথযাত্রী। অথচ এ উদ্যানের ঐতিহাসিক স্থানগুলো চিহ্নিত করে সেখানে ছোট আকারের প্রতিলিপি স্থাপন করে উদ্যানটিকে সংরক্ষণ করা যেত। অথচ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বড় শহরগুলোতে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে উদ্যান ও বড় ময়দানগুলোকে পুরোপুরি সংরক্ষণ করা হয়। আমাদের পাশের দেশ ভারতের কলকাতায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল পার্কের সামনের ময়দানকে (গড়ের মাঠ) সংরক্ষণ করা হয়েছে চমৎকারভাবে। এমনকি সেখানে ময়দানের পরিবেশ রক্ষার জন্য কলকাতার ঐতিহ্যবাহী পুস্তক মেলাও ময়দান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে শহরের উপকণ্ঠে মিলনমেলা ময়দানে। দিল্লিতে নেহরু পার্ক, লন্ডনের বিখ্যাত হাইড পার্ক ও নিউইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্ক রয়েছে সুরক্ষিত। সেখানে কোনো স্থাপনা নির্মাণের কথা কেউ ভাবতেই পারে না। মানুষ সেখানে বিনোদন ও বেড়ানোর জন্য আসে। সভা-সমিতিও হয়। গত বছর দুনিয়া কাঁপানো ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল নিউইয়র্কের জুকোটি পার্ক।
এ ছাড়া কিছু বড় বড় চত্বর বা প্রশস্ত সড়ক রাখা হয় শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও জনসাধারণের মিলনকেন্দ্র হিসেবে। যেমন প্যারিসের শাঁজেলিজে, চীনের তিয়েনআনমেন স্কয়ার, মিসরে রয়েছে তাহরির স্কয়ার। এ নামগুলো নানা কারণেই এখন বিশ্বজোড়া পরিচিত। কিন্তু ঢাকায় নষ্ট করে ফেলা হয়েছে মাঠ ও উদ্যানগুলোকে। রমনা উদ্যানই কেবল কোনোমতে টিকে আছে। এ ছাড়া তেমন কোনো খোলামেলা জায়গা রাখা হয়নি। সব ভরে গেছে দালানকোঠায়। দম বন্ধ করা ইমারতে ঠাসা এই শহরে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার জন্য মানুষের যাওয়ার জায়গা নেই কোথাও।
বাদ নেই কিছুই: সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এখন হচ্ছে সবই। সেখানে ঝুপড়ি বানিয়ে ভবঘুরেরা সংসার পেতেছে। এলাকাজুড়ে ফুচকা ও চটপটিবিক্রেতারা তাদের ঠেলাগাড়ির দোকান সাজিয়েছে। নিঃসন্দেহে ঢাকা শহরে একত্রে এত চটপটি-ফুচকার দোকান আর কোথাও পাওয়া যাবে না। ভাসমান যৌনকর্মীরাও স্থানটিকে নিজেদের ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে বাছাই করতে ভুল করেনি। বসছে জুয়ার আসর। আর গঞ্জিকাসেবীরা তো এটিকে তাদের অভয়ারণ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে ঢের আগেই।
ক্রীড়ানুরাগীরাই বা বাদ থাকবে কেন। অভিজাত গলফ থেকে শুরু করে হাল আমলের ক্রেজ ক্রিকেট, জনপ্রিয়তায় পড়তি ফুটবল অবধি নানা ক্রীড়ার অনুশীলন চলছে সারা দিন। কোথাও কোথাও তাস পেটানোও চলছে ছায়াময় গাছতলায়। এর মধ্যে ভোঁ ভোঁ করে ছুটছে মোটরসাইকেল। মোটরগাড়িও ঢুকে পড়ছে অনায়াসে। এমনকি গাড়ি চালানোর জন্য অনুশীলনের ক্ষেত্র হিসেবেও জায়গাটিকে পছন্দ করছে ইদানীং অনেকে। ফেরিওয়ালার তো অভাব নেই। উত্তর-পশ্চিমে বিকোচ্ছে নবীন শিল্পীদের চারুশিল্প। আর দক্ষিণ পাশে চলছে পূজা-অর্চনা। সঙ্গে যুক্ত আবর্জনার স্তূপ। তাহলে আর বাদ থাকল কী। কিছুই বাদ নেই, নেই উদ্যানটিও।
বিধ্বস্ত উদ্যান: সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতাস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল এ স্থানটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনা করে। প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ১৯৯৮ সালের ২৯ মার্চ। পেরিয়ে যাচ্ছে ১৫ বছর। কাজ শেষ হয়নি। মাঝখান থেকে উদ্যানটির দফারফা।এ মাঠেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। এবং দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী বীরত্বব্যঞ্জক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি পরাভূত করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে। অর্জন করেছিল স্বাধীনতা। এখানেই পরাজয়ের দলিলে স্বাক্ষর করেছিল পাকিস্তানি ঘাতকেরা। এ স্থানগুলোকে চিহ্নিত করে সেখানে ফলক নির্মাণ এবং উদ্যানটিকে দৃষ্টিনন্দন করে সাজিয়ে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ‘ঢাকাস্থ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতাস্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্প’ নামে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে তত্ত্বাবধানে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ করছে গণপূর্ত অধিদপ্তর।সূত্র জানায়, এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০০৭ সালে। বরাদ্দ করা হয়েছিল ৮১ কোটি ২৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকার বদল হওয়ায় প্রকল্পের কাজও বন্ধ হয়ে যায়। দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হয় ২০০৯ সালের জুলাই থেকে। এ পর্যায়ের জন্য বরাদ্দ হয়েছে ১৮১ কোটি ৬১ লাখ টাকা। প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১২ সালের ৩০ জুনে। প্রকল্প পরিচালক মিজান-উল-আলম প্রথম আলোকে জানান, এক বছর বাড়তি সময় নেওয়া হয়েছে। তবে যে গতিতে কাজ চলছে তাতে নির্ধারিত সময় অর্থাৎ চলতি জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। আবহাওয়ার বিরূপতা এবং অর্থ বরাদ্দের স্বল্পতায় কাজ চলছে ধীরগতিতে। গ্রীষ্মের উত্তাপ আবার বৃষ্টি-বাদলে কাচের স্তম্ভটি নির্মাণ মাঝে মাঝেই বন্ধ রাখতে হচ্ছে। ফলে কবে নির্মাণ শেষ হবে, তা নিশ্চিত নয়।
এ পর্যন্ত যা হয়েছে: প্রথম পর্যায়ে শিশুপার্ক-সংলগ্ন উদ্যানের উত্তর প্রান্তে নির্মাণ করা হয়েছে শিখা চিরন্তন ও ‘অ্যাপ্রোচ প্লাজা’, ভূগর্ভস্থ জাদুঘর, অর্ধবৃত্তাকার জলাধার।
এ ছাড়া একটি উন্মুক্ত মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে উদ্যানের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে বাংলা একাডেমীর সামনের অংশে। এখন এটি কার্যত ভবঘুরেদের আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে। তারা এখানে রান্না বা জামাকাপড় শুকানো ও আবাসিক স্থান হিসেবে ব্যবহার করছে। আর দর্শকদের বসার জন্য গ্যালারি থাকায় সেটিকে আড়াল হিসেবে ব্যবহার করে যৌনকর্মীরা। দিনের বেলায় জমে ওঠে তাসের জুয়া। বিভিন্ন এলাকা থেকে জুয়াড়িরা চলে আসে এ নিরাপদ ক্রীড়াকেন্দ্রে।
মূল স্তম্ভ: প্রকল্পের মূল যে লক্ষ্য, সেই স্বাধীনতা স্তম্ভটি নির্মাণ নিয়েই বিপাকে পড়েন প্রকৌশলীরা। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মেসার্স আরবানা নামের একটি প্রতিষ্ঠান এ স্তম্ভের নকশা করার দায়িত্ব পায়। স্থপতি কাশেফ মাহবুব ও মেরিনা তাবাসুম ১৬ বাই ১৬ বর্গফুট আয়তনের ১৫০ ফুট দীর্ঘ এ স্তম্ভের নকশা করেন। স্তম্ভটি নির্মাণ হবে স্বচ্ছ কাচ দিয়ে। ১৯ মিলিমিটার পুরু ও ৭৫ মিলিমিটার প্রস্থের কাচের ফলক পরপর সাজিয়ে এ স্তম্ভ নির্মাণের কৌশলগত ধারণা দেন নকশা প্রণয়নকারীরা।
বাস্তবায়ন করতে গিয়ে এ বিপুল ভারী কাচের ফলকগুলো কেমন করে দৃঢ় অবস্থায় রাখা যাবে, তা ঠিক করতে পারছিলেন না প্রকৌশলীরা। এর উপায় খুঁজতেই অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়।
প্রকল্প পরিচালক জানান, ২১টি করে কাচের ফলক একের পর এক সাজিয়ে একটি ‘প্যানেল’ করা হচ্ছে। আবহাওয়ার পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে মাঝে মাঝে কাজ বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
উদ্যান নয়, যেন ভাগাড়: ভাগাড়ের সঙ্গে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বাস্তবে কোনো তফাত পাওয়া এখন দুষ্কর। অধুনা ‘ছবির হাট’ নামে পরিচিত উদ্যানের উত্তর-পশ্চিম কোণের প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকলেই চোখে পড়বে সিটি করপোরেশনের আবর্জনা রাখার ধাতব বাক্স। সেটি উপচে আশপাশে ছত্রখান হয়ে আছে রাজ্যের বর্জ্য। বৃষ্টির পানি জমে জায়গাটির ঘিনঘিনে অবস্থা। সেটি পেরিয়ে উদ্যানের ভেতরের পায়ে চলা পথ দিয়ে চলতে থাকলে দেখা যাবে, সারা মাঠে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য ডাবের খোল, বিস্কুট-চিপসের প্যাকেট, বাঁশ-কাঠ-কাগজের টুকরা ও পলিথিন ব্যাগ। তরিতরকারির খোসা, ভাঙা ডিমের খোসা। কোথাও কোথাও ইট-বালু-সুরকির স্তূপ। এমন কোনো আবর্জনা নেই, যার স্থান হয়নি এ উদ্যানে।গাছের শাখায় শহীদদের স্মৃতিফলক, কংক্রিটের বেঞ্চে ঝুলছে উদ্যানকে আবাস বানিয়ে ফেলা ভবঘুরেদের কাপড়। কোথাও দেখা যাবে ইটের চুলায় রান্না চাপিয়েছে তারা। স্তম্ভের পাশের জলাধারের পচা পানিতেই চলছে গোসল, কাপড়চোপড় ধোয়া। সব মিলিয়ে এক বিদঘুটে পরিবেশ।
মাদকের অভয়ারণ্য: বিকেল থেকেই উদ্যানের পশ্চিম পাশের গাছতলাগুলোতে উপস্থিতি শুরু হয় এক-দুজন করে। ছোট ছোট দলে পরিণত সন্ধ্যার আগেই। বাতাস ভারী হয়ে ওঠে গাঁজার ধোঁয়ায়। চলতে থাকে গভীর রাত পর্যন্ত। গাঁজা ছাড়াও এখানে ফেনসিডিল ও অন্যান্য মাদকও সেবনের ব্যবস্থা রয়েছে।বিষয়টি কারও অজানা নয়। প্রকল্প পরিচালক সাফ বলে দিলেন, ‘কোনো কিছুই আমাদের অজানা নেই। কিন্তু আমাদের কিছু করার নেই। এসব যারা চালাচ্ছে, তারা অনেক শক্তিশালী। তারা কারা, তা-ও সবার জানা। এত বড় উদ্যান (৬৭ একর) পাহারা দেওয়ার জন্য আমাদের মাত্র ১৯ জন আনসার আছে। আনসারদের তারা পাত্তা দেয় না। তার পরও আমরা দোকান উচ্ছেদ, মাদক সেবন বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছি বেশ কয়েক বার। কিছু হয়নি। আমাদের প্রকৌশলীরা তাদের হাতে মার খেয়েছেন। সন্ত্রাসীরা প্রকল্প বাস্তবায়নে দায়িত্বে নিয়োজিত নির্বাহী প্রকৌশলীর হাত ভেঙে দিয়েছে।