একটি আপসের ময়নাতদন্ত
রাত প্রায় ১০টা। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বড় একটি মাঠ পাড়ি দিচ্ছিলেন তিনজন। ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ গোঙানি শুনে তাঁরা কাছের ফাঁড়ি থেকে পুলিশ ডেকে আনলেন।
তাঁরা দেখলেন, তালগাছের নিচে একটি মেয়ে নিথর পড়ে আছেন। কয়েকজন পুরুষ দৌড়ে পালাচ্ছিলেন। পুলিশ চারজনকে ধরে ফেলে। পরে আরেকজন গ্রেপ্তার হন।
মেয়েটির জ্ঞান ফিরলে রক্তাক্ত অবস্থায় তাঁকে শেরেবাংলা নগর থানায় নেওয়া হয়। তিনি গণধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেন।
এজাহারে পোশাকশ্রমিক মেয়েটি বলেন, তাঁর আনসার সদস্য বন্ধুটি ফোন করে ডেকেছিলেন। কথা বলতে বলতে রাত সাড়ে নয়টার দিকে তাঁরা মাঠে ঢোকেন। আর তখনই ছয়জন লোক এসে মেয়েটিকে ধর্ষণ করেন। বন্ধুটি ধর্ষণ করেননি, তবে সাহায্য করেছেন।
পরে হাকিমের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে আনসার সদস্যটি বলেন, আক্রমণকারীরা তাঁর ‘সোর্স’ এবং তিনি মেয়েটিকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন।
বন্ধুটির বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি—এ কথা বলে অভিযোগপত্রে পুলিশ তাঁর ও অজ্ঞাতনামা দুজনের অব্যাহতি চান। গ্রেপ্তার চারজন অভিযুক্ত হন।
পুলিশের ঠিকানা যাচাইয়ের নোট অনুযায়ী, অভিযুক্ত চতুর্থ ব্যক্তি একজন পুলিশ কনস্টেবল। তিনি দ্রুতই জামিনে বেরিয়ে যান।
এর আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক ডিএনএ পরীক্ষণাগারে মেয়েটির রক্তমাখা সালোয়ারে পাওয়া বীর্যের ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়েছিল। এর সঙ্গে কনস্টেবলসহ তিনজনের ডিএনএ শতভাগ মিলে যায়।
গণধর্ষণের ঘটনাটি ২০১৩ সালের। পরের বছর ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ৪-এ চারজনের বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়। পুলিশ আর সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) সাক্ষ্য দিতে শুধু অভিযোগকারী মেয়েটিকে হাজির করেন।
গত বছরের ১২ অক্টোবর সাক্ষ্য শেষ করে মেয়েটি বলেন, ‘আমি পূর্ববিরোধের কারণে এই মামলা করি। এখন আর মামলা করব না।’ পিপি তাঁকে বৈরী ঘোষণা বা পাল্টা জেরা করতে পারতেন। করেননি।
ওই দিনই ট্রাইব্যুনালের ভারপ্রাপ্ত বিচারকের রায়ে চারজন বেকসুর খালাস পান। রায়ে বিচারক লেখেন, অভিযোগকারীর সাক্ষ্য বলছে, স্থানীয়ভাবে আপস-মীমাংসার মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। আসামি খালাস পেলে তাঁর আপত্তি নেই, কোনো অভিযোগ নেই।
বিচারক আরও লিখেছেন, ‘তাই অত্র মামলা নিষ্পত্তি করতে বিস্তারিত আলোচনা করার কোনো আবশ্যকতা নেই।’ তারপর তিনি লেখেন, রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পারেনি।
২০১৫ সালের জানুয়ারিতে মেয়েটি আদালতে হলফনামায় বলেছিলেন, মামলা করার পর তিনি একা ও নিঃস্ব হয়ে যান। আসামিদের স্বজনেরা তাঁর বিয়ে দেন এবং তাঁর স্বামীকে স্বাবলম্বী করতে সাহায্য করেন। তাই আদালত আসামিদের জামিন, অব্যাহতি বা খালাস দিলে তাঁর আপত্তি নেই।
একাধিক সূত্র বলছে, মেয়েটির সঙ্গে আপসের ব্যবস্থা করেছিল কনস্টেবলের পরিবার।
ধর্ষণের পীড়ার জের একটি মেয়েকে সারা জীবন তাড়া করে। সমাজে, পরিবারে তাঁকে মাথা নিচু করে বাঁচতে হয়। এই আপসের নেপথ্যে যেমন মেয়েটির স্বামী-সন্তান নিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদ ছিল, তেমনি বিরুদ্ধপক্ষের চাপ আর একাধিক পক্ষের মধ্যস্থতা ছিল। মেয়েটির সুরক্ষার জন্য সেসব কথা বিস্তারিত লেখা যাচ্ছে না।