মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের ঠিক আগমুহূর্তে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হন দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীরা। একাত্তর সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় করা অন্তত তিনটি মামলার রায়ে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্র, সহযোগিতা ও হত্যাকাণ্ডে কারা জড়িত তা উঠে এসেছে। তিন মামলায় চারজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এর মধ্যে বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনার পাশাপাশি মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামী এবং দলটির সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অন্য দুই আসামি হলেন আশরাফুজ্জামান ওরফে নায়েব আলী খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীন। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর দেওয়া রায়ে আশরাফুজ্জামানকে বুদ্ধিজীবী নিধন পরিকল্পনার ‘চিফ এক্সিকিউটর’ এবং মুঈনুদ্দীনকে ‘অপারেশন ইনচার্জ’ বলে উল্লেখ করেন। এই রায়ের পর আট বছর পেরিয়ে গেলেও তাদের ফেরত আনা যায়নি।
স্বাধীনতার পরপর মুঈনুদ্দীন পাকিস্তানে চলে যান এবং এরপর সেখান থেকে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে যান। এখন তিনি টটেনহামে আছেন। মুঈনুদ্দীন যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের মুসলিম স্পিরিচুয়াল কেয়ার প্রভিশনের পরিচালক। আর আশরাফুজ্জামান থাকেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের জ্যামাইকায়। তিনি ইসলামিক সার্কেল অব নর্থ আমেরিকার (আইসিএনএ) সদস্য।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই পলাতক আসামিকে ফিরিয়ে আনতে সরকার চেষ্টা করছে বলে জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। গত রোববার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে সম্প্রতি তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে। তখন বিষয়টি নিয়ে তাঁদের মধ্যে কথা হয়। আইনমন্ত্রী জানান, ব্রিটিশ হাইকমিশনার তাঁকে বলেছেন, এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দাবি জানাতে। দুজনকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে দাবি জানানো হবে বলে জানান আইনমন্ত্রী।
মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে একাত্তর সালে ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মোট ১১টি অভিযোগ আনা হয়ছিল, ট্রাইব্যুনালের রায়ে সব কটি প্রমাণিত হয়েছে। ওই ১৮ জন বুদ্ধিজীবী হলেন, দৈনিক ইত্তেফাকের তৎকালীন কার্যনির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন, পিপিআইয়ের (পাকিস্তান প্রেস ইন্টারন্যাশনাল) প্রধান প্রতিবেদক সৈয়দ নাজমুল হক, দৈনিক পূর্বদেশের প্রধান প্রতিবেদক এ এন এম গোলাম মোস্তফা, বিবিসির সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন আহমেদ, শিলালিপির সম্পাদক সেলিনা পারভীন, দৈনিক সংবাদের যুগ্ম সম্পাদক শহীদুল্লা কায়সার, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক সিরাজুল হক খান, ড. মো. মুর্তজা, ড. আবুল খায়ের, ড. ফয়জুল মহিউদ্দিন, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ক্লিনিক্যাল মেডিসিন ও কার্ডিওলজির অধ্যাপক ফজলে রাব্বী ও চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. আলীম চৌধুরী। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর দিবাগত রাত থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ওই বুদ্ধিজীবীদের অপহরণের পর হত্যা করা হয়। তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের মরদেহ পরে রায়েরবাজার ও মিরপুরের বধ্যভূমিতে পাওয়া গেছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউর তাপস কান্তি বল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বুদ্ধিজীবী হত্যা ও পরিকল্পনায় পৃথক তিন মামলায় চারজনকে দোষী সাব্যস্ত করে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করা হয়েছে।’ মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান বাদে বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনার পাশাপাশি মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধের দায়ে মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।
বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরে ট্রাইবু৵নালের রায়ে বলা হয়, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের হিংস্রতা মৌলিক মানবতাবোধের জন্য হুমকি। ইতিহাস বলে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা সময়ে বেসামরিক জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে নানা ধরনের নৃশংস আক্রমণ হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়নি, যেখানে জাতির বিবেক হিসেবে পরিচিত বুদ্ধিজীবীদের লক্ষ্য করে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে। এই হত্যাযজ্ঞ শুধু অপরাধীর অপরাধের মাত্রাই বাড়ায়নি, গোটা জাতির জন্য যন্ত্রণার ছাপ এঁকে দিয়েছে।
দশকের পর দশক ধরে জাতি ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের সদস্যরা সেই অব্যক্ত যন্ত্রণা বুকে চেপে আছেন, আইনের অক্ষর এখানে নির্বিকারভাবে বসে থাকতে পারে না। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে অপরাধের গভীরতার বিচারে একমাত্র মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে ন্যায়বিচার করা হবে।
মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মো. কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, দেশের বাইরে থাকা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তসহ পলাতক আসামিদের বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের এনসিবি (ইন্টারপোলের ঢাকা শাখা) থেকে দেশের বাইরের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করা হয়ে থাকে। যেসব দেশের সঙ্গে বন্দী আদান-প্রদান চুক্তি আছে, এমন দেশে আসামির খোঁজ পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলার রায়ে ট্রাইব্যুনাল উল্লেখ করেন, জামায়াতে ইসলামীর মস্তিষ্কপ্রসূত ঘাতক বাহিনী আলবদর একাত্তরে বুদ্ধিজীবী নিধনের যে নীলনকশা বাস্তবায়ন করেছে, তা গোটা জাতির বুকে ক্ষত হয়ে রক্ত ঝরাচ্ছে বলে বিশ্বাস করেন ট্রাইব্যুনাল।
বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের অন্যতম পরিকল্পনাকারী জামায়াতের সাবেক আমির নিজামীর ফাঁসি কার্যকর হয় ২০১৬ সালের ১০ মে রাতে। নিজামীর ক্ষেত্রে আদালত রায়ে পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘আলবদর বাহিনী যে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল, তার ওপর নিজামীর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ ছিল। আর আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর হয় ২০১৫ সালের নভেম্বরে। মুজাহিদের মামলায় ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেছিলেন, একাত্তরে ছাত্র সংঘের সদস্যরা আলবদর বাহিনীতে রূপান্তরিত হয়। মুজাহিদ ছাত্র সংঘের ঊর্ধ্বতন নেতা ছিলেন। ক্ষমতাধারী রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে আলবদর গঠন থেকে শুরু করে হত্যা-নিধনযজ্ঞের শেষ পর্যন্ত এই বাহিনীর ওপর মুজাহিদের কর্তৃত্ব ছিল।’
শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরীর মেয়ে অধ্যাপক ডা. নুজহাত চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আশরাফুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রে ও মুঈনুদ্দীন যুক্তরাজ্যে থাকায় সংশ্লিষ্ট দেশের নিজস্ব নীতির কারণে ওই দুজনকে দেশে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। দুঃখবোধের জায়গা এই যে স্বাধীন বিচার প্রক্রিয়ায় তাদের অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পরেও পাশ্চাত্য বিশ্ব বিচার প্রাপ্তি বাধাগ্রস্ত করে মানবিক অধিকার ক্ষুন্ন করছে। বঙ্গবন্ধুর খুনিসহ মানবতাবিরোধী অপরাধী যারা দেশের বাইরে আছে, তাদের ফিরিয়ে আনার দাবি জানান তিনি।