এক সকালেই তিন চিকিৎসকের মৃত্যু
ভোর হতে না হতেই মৃত্যুর প্রথম সংবাদটি আসে চট্টগ্রাম থেকে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) করোনা রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে নিজেও আক্রান্ত হওয়া চিকিৎসক নুরুল হক হার মানেন মৃত্যুর কাছে। এই খবর জানাজানি হতে না-হতেই গতকাল বুধবার সকালে আরও দুজন চিকিৎসকের মৃত্যুর খবর স্তব্ধ করে দেয় চিকিৎসক সমাজসহ সাধারণ মানুষকে। তাঁদের একজনের মৃত্যু হয়েছে ঢাকায় অন্যজন মারা গেছেন দিনাজপুরে।
এ নিয়ে গত আট দিনে (১০ জুন থেকে ১৭ জুন) করোনায় আক্রান্ত হয়ে এবং করোনার উপসর্গ নিয়ে ১২ চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) তথ্য অনুযায়ী করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে ও উপসর্গ নিয়ে দেশে এখন পর্যন্ত ৪১ চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে।
করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগীদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে একেবারে সম্মুখযোদ্ধার দায়িত্বে রয়েছেন চিকিৎসকেরা। অন্যের জীবন বাঁচাতে নিজের সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন তাঁরা। করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে তাঁরাও সংক্রমিত হচ্ছেন, মৃত্যুর ঘটনাও বাড়ছে। একের পর এক চিকিৎসকের মৃত্যুর ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যেও উদ্বেগ বাড়ছে।
বিএমএর তথ্য অনুযায়ী, গতকাল পর্যন্ত ৩ হাজার ২৭৪ চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে চিকিৎসক ১ হাজার ৩৫, নার্স ৮৮৫ এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী ১ হাজার ৩৫৪ জন।
গতকাল মারা যাওয়া তিন চিকিৎসক হলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটের অবসরপ্রাপ্ত সহযোগী অধ্যাপক আশরাফুজ্জামান, দিনাজপুরের এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক পরিচালক শাহ আবদুল আহাদ ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতালের জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক নুরুল হক।
বিএমএর তথ্য অনুযায়ী, গতকাল সকালে ঢাকার কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আশরাফুজ্জামান। তিনি রংপুর মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিলেন।
প্রথম আলোর দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, গতকাল সকালে জেলার এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান চিকিৎসক শাহ আবদুল আহাদ (৬৭)। তাঁর গ্রামের বাড়ি চিরিরবন্দর উপজেলার আলোকডিহী ইউনিয়নে। ২০০৯ সালের ১৫ জুন তিনি এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক পদে যাগ দিয়েছিলেন। একই বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি ওই পদে দায়িত্ব পালন করেন।
দিনাজপুর জেলার সিভিল সার্জন আবদুল কুদ্দুস প্রথম আলোকে বলেন, চিকিৎসক আবদুল আহাদ আগে থেকেই ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন। কয়েক দিন আগে তাঁর জ্বর ও শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। ৮ জুন তাঁর নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পরদিন পরীক্ষার প্রতিবেদনে করোনা পজিটিভ আসে।
এ ছাড়া চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতালের আইসিইউতে মারা যান নুরুল হকের বাড়ি কক্সবাজারের মহেশখালীর কুতুবজোম ইউনিয়নে। তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিলেন।
বিএমএর চট্টগ্রাম শাখার সাধারণ সম্পাদক ফয়সল ইকবাল চৌধুরী প্রথম আলোকে জানান, গত শুক্রবার থেকে জ্বর অনুভব করেন নুরুল হক। রোববার তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সোমবার তাঁর শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায়। এরপর তাঁকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল।
>সবশেষ গতকাল দেশের তিন জেলায় তিন চিকিৎসকের মৃত্যু
আট দিনে মারা গেলেন ১২ জন চিকিৎসক
এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৩৫ জন চিকিৎসক
৮৮৫ জন নার্স এবং ১,৩৫৪ জন অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত
চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, করোনার প্রাদুর্ভাবের মধ্যে নুরুল হক চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতালের আইসিইউতে দায়িত্ব পালন করছিলেন। সেখানে কিছু করোনা রোগীর চিকিৎসার দায়িত্বে ছিলেন তিনি। সেই আইসিইউতেই তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।
প্রয়াত চিকিৎসক রেজাউল করিমের পরিবারের বক্তব্য
বিএমএর তথ্যের ভিত্তিতে গতকাল প্রথম আলোয় ‘এক সপ্তাহে ১০ চিকিৎসকের মৃত্যু’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। এতে ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চট্টগ্রামের (ইউএসটিসি) সাবেক উপাচার্য এম রেজাউল করিম করোনায় সংক্রমিত হয়ে ঢাকা সিএমএইচে মারা গেছেন বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু গতকাল তাঁর পরিবার প্রথম আলোকে জানিয়েছে, রেজাউল করিম করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে মারা যাননি। তাঁর মৃত্যুর কারণ হৃদ্রোগ। তিনি সিএমএইচে নয়, চট্টগ্রামের একটি হাসপাতালে মারা গেছেন।
প্রথম আলোর পক্ষ থেকে বিষয়টি বিএমএর দপ্তর সম্পাদক শেখ শহীদ উল্লাহকে জানানো হয়। এরপর বিএমএ করোনায় সংক্রমিত ও উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া চিকিৎসকদের তালিকা সংশোধন করেছে। এতে করোনায় মারা যাওয়া চিকিৎসকদের তালিকা থেকে এম রেজাউল করিমের নাম বাদ দিয়েছে বিএমএ।