চিকুনগুনিয়া। আফ্রিকা মহাদেশের তানজানিয়ার একটি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নিজস্ব ভাষার এই শব্দ বাংলাদেশে, বিশেষ করে ঢাকায় সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে আলোচিত। কারণ, এডিস মশাবাহিত চিকুনগুনিয়া জ্বরে ভুগছে বিপুলসংখ্যক মানুষ। ঢাকা শহরে যে বাসায়ই এই ভাইরাস সংক্রমিত হয়েছে, সে বাসায় গড়ে দুজনের বেশি (২.৬ জন) আক্রান্ত হয়েছে।
প্রথম আলোর ফেসবুক পেজের মাধ্যমে পরিচালিত জরিপ থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত পরিবারের ৫ হাজার ৫৪৩ জন এই জরিপে অংশ নেন। আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রায় ৭৬ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা জ্বরের সময় চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েছেন।
জরিপে অংশ নেওয়া কাজী কামাল নামের একজন মন্তব্য করেছেন, ‘ছেলে, মেয়ে, বউ জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার দেড় মাস হলো। আমার এক মাস। জ্বর নাই ঠিকই, কিন্তু ব্যথা আছে সবার। স্বাভাবিক জীবন ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি। ব্যথা যাচ্ছে না।’
স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ এবং এই জ্বরের চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসকেরাও বলছেন, চিকুনগুনিয়ার উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, জ্বরের সময় নিদারুণ যন্ত্রণা আর জ্বরের পরও গিঁটে গিঁটে অসহ্য ব্যথা। আক্রান্ত ব্যক্তিরা স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা পর্যন্ত করতে পারছেন না। তানজানিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের মাকোন্ডে জাতিসত্তার নিজস্ব ভাষা কিমাকোন্ডে থেকে আসা চিকুনগুনিয়া শব্দটির অর্থই গিঁটের ব্যথায় কুঁকড়ে যাওয়া। আক্রান্ত ব্যক্তিরা যে ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছেন, তা জরিপে অংশ নেওয়া প্রায় ১ হাজার ৯০০ জনের করা স্বতঃস্ফূর্ত মন্তব্য থেকেও স্পষ্ট।
প্রথম আলো জরিপ
ঢাকায় চিকুনগুনিয়া—এই শিরোনামে ১২ জুলাই বিকেল পাঁচটা থেকে জরিপের ছক প্রথম আলোর পাঠকদের অংশগ্রহণের জন্য অনলাইনে দেওয়া হয়। স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণকারীরা অনলাইনে লগইন করে এবং কিউআর কোড স্ক্যান করে এই জরিপে অংশ নেন। ১৫ জুলাই বিকেল ৫টা পর্যন্ত ৪ দিনে ঢাকার ৪৯টি থানার বাসিন্দারাই এতে অংশ নিয়েছেন বলে ফলাফলে দেখা যায়।
এটি প্রথাগত, বিজ্ঞানভিত্তিক কোনো জরিপ নয়। অনলাইন পাঠকদের স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণমূলক জরিপ। ফলে এই জরিপে পাওয়া তথ্য-উপাত্তের উপযোগিতা বিশ্লেষণ করতে বললে জরিপ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ওআরজি-কোয়েস্ট রিসার্চ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মঞ্জুরুল হক বলেন, এটা প্রচলিত অর্থে জনমত জরিপ নয়। একে পূর্ণাঙ্গ বৈজ্ঞানিক জরিপও বলা যাবে না সত্য, তবে এ থেকে পরিস্থিতির বিষয়ে একটা ধারণা পাওয়া যায়।
চিকুনগুনিয়া পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে এই জরিপকে ব্যাখ্যা করতে বললে জনস্বাস্থ্যবিদ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক পরামর্শক এ এম জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, অনলাইন জরিপে স্বাভাবিকভাবেই যাদের ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ আছে তারাই অংশ নেয়। আমাদের বাস্তবতায় অনলাইনে তরুণেরা বেশি অংশ নেয়। স্বভাবতই জনগোষ্ঠীর বাকি অংশের মতামত বা কী পরিমাণ মানুষ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হলো, তার পূর্ণাঙ্গ চিত্র থাকে না। তবে তাৎক্ষণিকভাবে রোগনিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য এই সংখ্যা জানা জরুরি নয়। চিকুনগুনিয়া কেন হচ্ছে, কীভাবে ছড়াচ্ছে, কোন কোন এলাকায় বেশি হচ্ছে, এটা আমরা ইতিমধ্যেই জেনে গেছি। মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে—এটা জানাই প্রতিরোধমূলক উদ্যোগ নেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
প্রতি বাড়ি তথা খানা থেকে একজনকে জরিপে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। অংশগ্রহণকারীদের দেওয়া তথ্যে দেখা যায়, ৩০ শতাংশ বাড়িতে অন্তত একজন করে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। দুজন করে আক্রান্ত হয়েছে শতকরা ২৩ ভাগ বাড়িতে। প্রতি ঘরে তিনজন এবং পাঁচজন বা তার বেশি আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা সমান—শতকরা ১৭ ভাগ। আর ১৩ শতাংশ পরিবারে আক্রান্ত হয়েছে চারজন করে। এককথায় বললে, প্রতি ঘরে গড়ে ২ দশমিক ৬ জন আক্রান্ত হয়েছে।
এ তথ্য বিশ্লেষণ করে বলা যায়, যে বাসায় চিকুনগুনিয়া ভাইরাস ঢুকেছে, সেখানে পরিবারের একাধিক সদস্য আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকছে। ফলে এ থেকে বাঁচতে হলে বা ঘরের অন্যদের আক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা করতে হলে মূল কাজ হবে ঘরকে মশামুক্ত করা। ঘুমের সময় অবশ্যই মশারি ব্যবহার করা, বিশেষ করে সকাল-সন্ধ্যায়। কারণ, এডিস মশা দিনের বেলায় কামড়ায়। আর এই মশা বাসাবাড়ির আঙিনা, আশপাশে জমা পানিতে জন্মে। জন্মে ডাবের খোল, কোমল পানীয়ের ক্যান, ফুলের টব, পরিত্যক্ত টায়ার ও এসি-ফ্রিজের তলায় যে পানি জমে, তাতে। ফলে এসব জায়গা নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। পাশাপাশি নির্মাণাধীন ভবনের পানির চৌবাচ্চা নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে। বাড়ির বাসিন্দাদের এসব বিষয়ে সজাগ হতে হবে নিজেদের সুরক্ষার জন্যই।
তবে প্রশাসনিকভাবে শহরের মশা মারার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছে কি না, তা নিয়ে সমালোচনা চলছে। এই জরিপেও এ বিষয়ে একটি প্রশ্ন রাখা হয়েছিল। ‘আপনার এলাকায় শেষ কবে মশার ওষুধ দিতে দেখেছেন বা শুনেছেন?’ ৭ হাজার ৩০ জন এই প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। এর মধ্যে ৫৯ শতাংশ অংশগ্রহণকারী বলেছেন, দুই মাসের মধ্যে তাঁরা মশার ওষুধ ছিটাতে দেখেননি। দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকা থেকে জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৫০ শতাংশ বলেছেন, গত দুই মাসের মধ্যে তাঁরা তাঁদের এলাকায় ওষুধ ছিটাতে দেখেননি বা শোনেননি। উত্তর সিটি করপোরেশনে এই হার ৬৩ শতাংশ।
ঈদুল ফিতরের পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলেছে। সকালবেলায় শিশুরা স্কুলে যায়, দিনের একটা বড় সময় স্কুলে থাকে। ফলে এখন শিশু ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে চিকুনগুনিয়া সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি থাকছে। এর জন্য অবশ্যই স্কুল কর্তৃপক্ষের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। সিটি করপোরেশনগুলোও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন্দ্র করে মশক নিধনে বিশেষ ব্যবস্থা বা উদ্যোগ নিতে পারে।
চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব আগামী সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। লম্বা সময়ের কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে রোগটি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। ইতিমধ্যে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর চট্টগ্রামসহ সাতটি জেলায় চিকুনগুনিয়া ছড়িয়ে পড়েছে। ঢাকার আশপাশে আছে নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী পাওয়া গেছে নরসিংদীতে।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মাত্র ২৪ শতাংশ চিকিৎসকের কাছে যাননি। যেহেতু এই জ্বরে প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য ওষুধ খাওয়ার প্রয়োজন নেই বলে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন; ফলে এই সংখ্যায় উদ্বেগের কিছু নেই। তবে যথাযথ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া ভালো। চিকুনগুনিয়া শনাক্ত করার যন্ত্র শুধু আইইডিসিআরে আছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) এবং বেসরকারি অ্যাপোলো হাসপাতাল জানিয়েছে, তাদেরও চিকুনগুনিয়া শনাক্ত করার যন্ত্র আছে। তারা যথাক্রমে চার ও পাঁচ হাজার টাকা নেয়। তবে আইইডিসিআর বিনা মূল্যে নমুনা পরীক্ষা করে।
চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে গঠিত জাতীয় কমিটির সদস্য জাকির হোসেন বলেন, ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য একটা পূর্ণ রোগতাত্ত্বিক জরিপ করা দরকার। যে জরিপ থেকে জানা যাবে কী পরিমাণ মানুষ আক্রান্ত হলো, কেন এই রোগ এভাবে ছড়িয়ে পড়ল, কোন এলাকায় বেশি আক্রান্ত হলো, কোন বয়সের বা কোন পেশার বেশি আক্রান্ত হলো, তারা কী ধরনের চিকিৎসা নিয়েছে ইত্যাদি। এর ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যতে চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেওয়া সহজ হবে।