এক দিনের সম্পাদকের সঙ্গে মতিউর রহমান
পঞ্চম শ্রেণি থেকে শিশু সাংবাদিকতা করছে রূপকথা রহমান। ঢাকার হলিক্রস কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির এই শিক্ষার্থী এক দিনের জন্য পেয়েছিল প্রথম আলো সম্পাদকের প্রতীকী দায়িত্ব। উপলক্ষ ছিল ‘বিশ্ব শিশু দিবস’। কোনো শিশু এক দিনের জন্য সংবাদমাধ্যম, সরকার, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ গুরুত্বপূর্ণ আরও নানান ক্ষেত্রের দায়িত্ব যখন নেয়, তখন একে ইংরেজিতে বলা হয় ‘কিডস টেকওভার’। এটি বিশ্ব শিশু দিবস উপলক্ষে ইউনিসেফের একটি উদ্যোগ। এর মাধ্যমে তারা শিশুদের প্রতি অঙ্গীকার রক্ষা করে, স্মরণ করিয়ে দেয় শিশুদের প্রতি বড়দের দায়িত্বের কথা। সারা পৃথিবীতে কিডস টেকওভারের মাধ্যমে শিশুরা গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়ে নিজেদের মতপ্রকাশ, ধারণার বাস্তবায়ন এবং পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ পায়। রূপকথা রহমানও প্রথম আলো সম্পাদকের প্রতীকী দায়িত্ব নিয়ে বলেছে শিশু অধিকার নিয়ে তার উদ্বেগের কথা। জানিয়েছে মতামত ও দিয়েছে পরামর্শ। প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের সঙ্গে তার আলাপচারিতায় উঠে এসেছে শিশু অধিকার নিশ্চিতকরণে গণমাধ্যমের ভূমিকা ও চ্যালেঞ্জসহ নানা বিষয়।
ফুলের তোড়া ও এক দিনের সম্পাদকের পরিচয়পত্র নিয়ে প্রস্তুত ছিলেন মতিউর রহমান। ঢাকার কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে সম্পাদকের কক্ষে ঢোকার পর রূপকথা রহমান পেল উষ্ণ অভ্যর্থনা। মতিউর রহমান তাঁর আসন ছেড়ে দিলেন এক দিনের সম্পাদকের জন্য। তিনি নিজে বসলেন সম্পাদকের সামনের আসনে। বললেন, ‘আমার তো বয়স হয়েছে, আমি চাই, তরুণ কেউ আমার চেয়ারটিতে বসুক। আপনি এই দায়িত্ব নেওয়ায় আমি আনন্দিত। এবার আপনি বলুন, কেমন লাগছে সম্পাদকের দায়িত্ব নিতে পেরে?’
বলে নেওয়া ভালো, সম্পাদকের আসনে বসার আগে রূপকথা রহমান প্রথম আলো কার্যালয়ের প্রায় পুরোটাই ঘুরে দেখেছে। কথা বলেছে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে। কাছ থেকে দেখেছে সবার কাজ। একাধিক সভায় অংশ নিয়ে সম্পাদক হিসেবে জানিয়েছে নিজের মতামত ও দিয়েছে নানা পরামর্শ। তাই মতিউর রহমানের প্রশ্নে রূপকথা রহমান বলল, ‘আমি শিশু সাংবাদিকতা করছি বেশ কয়েক বছর ধরে। তবে আজই প্রথম কোনো প্রিন্ট মিডিয়ার কর্মকাণ্ড কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেলাম। তাই প্রথম আলোর এক দিনের সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়ে আমি দারুণ রোমাঞ্চিত।’
রোমাঞ্চের পাশাপাশি নিজের উদ্বেগের কথাও বলল রূপকথা, ‘আমাদের দেশে এখন অনেক সংবাদমাধ্যম। নিউজফিডে সারাক্ষণই অনেক খবর দেখি। অধিকাংশেরই সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকে। অনেক সময় ভুয়া খবর ও কুসংস্কার ছড়িয়ে পড়ে। খেয়াল করে দেখবেন, এসব ক্ষেত্রে মারাত্মক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে শিশুরা।’ এর সঙ্গে একটি প্রশ্নও জুড়ে দেয় রূপকথা, ‘এসবের বেলায় সরকারের দায়দায়িত্ব তো আছেই, আপনাদেরও অনেক দায়িত্ব। জনগণকে সচেতন করে তোলার বেলায় আপনাদের ভাবনাটা কী?’
রূপকথার প্রশ্নে মতিউর রহমান প্রথম আলোর নিজস্ব নারী ও শিশুনীতির কথা জানান। তিনি বলেন, এই নীতিগুলো প্রথম আলোর প্রত্যেককে জানতে হয়, শিখতে হয়, এসব নিয়ে তাঁরা আলোচনা করেন এবং কাজে রূপান্তর করার সর্বাত্মক চেষ্টাও করেন। তিনি প্রথম আলোর মূল্যবোধের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘আমাদের মূল্যবোধগুলো হলো সুসাংবাদিকতা, জনমুখিনতা, সৃজনশীলতা, সংহতি ও বদলের সহযোগী। আমরা বদলের কথা বলি প্রতিদিন। শিশু ও নারীদের প্রতি আমাদের একটা সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি আছে। পত্রিকার সব পাতায় আমরা শিশু ও নারীদের কীভাবে উপস্থাপন করব, এ ব্যাপারে আমরা সচেতন। আশা করি, ধীরে ধীরে দেশের সব সংবাদমাধ্যমে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।’
নিজেদের অবস্থান জানিয়ে দেওয়ার পর মতিউর রহমান শিশু অধিকার নিয়ে আরও কী করা জরুরি, তা জানতে চান রূপকথার কাছে। রূপকথা বলে, ‘আমাদের দেশে কোনো গবেষণা হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছোট একটা নমুনা নিয়ে, নির্দিষ্ট কিছু স্থানের অল্প কিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলে একটা ফল প্রকাশ করা হয়। তাই এ ক্ষেত্রে আমার একটা প্রস্তাব আছে। প্রথম আলো যেহেতু দেশের সব অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে, তাই আপনারা যেন সব জায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে শিশুদের জন্য একটি তথ্যভান্ডার গড়ে তোলেন। শিশুদের সমস্যাগুলো বাড়ছে নাকি কমছে, তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের কী অবস্থা, তাদের পড়াশোনার কী অবস্থা, স্বাস্থ্যের খবর কী এবং তাদের পারিবারিক অবস্থাও যেন তাতে জানা যায়।’
এক দিনের সম্পাদকের কাছ থেকে প্রস্তাবটি শুনে মতিউর রহমান বলেন, ‘নিঃসন্দেহে ভালো প্রস্তাব। এটা করতে পারলে খুব ভালো হবে।’
রূপকথা তার প্রস্তাবের বিষয়টি আরও খোলাসা করে। তার মতে, বছরে দুবার করেও যদি একই স্থান থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়, তাহলে শিশু অধিকার বাস্তবায়নে উন্নতি-অবনতির বিষয়গুলো পরিষ্কার হবে। সে বলে, ‘ধরা যাক, ৬৪ জেলার শিশুদের জিজ্ঞাসা করা হলো, তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ১ থেকে ১০-এর মধ্যে কত নম্বর পাবে? কিংবা তারা তাদের আশপাশে স্বাস্থ্যের জন্য যে সহযোগিতা প্রয়োজন, তা পাচ্ছে কি না; পরিবার পাশে থাকছে কি না? এগুলো দেখে অবশ্যই আমরা একটা সাধারণ ধারণা পেতে পারি। এর ফলে শিশুদের কোনো সমস্যার ব্যাপারে খুব সহজে একটা গ্রহণযোগ্য উপসংহারেও আসা যাবে।’
রূপকথার প্রস্তাবে মতিউর রহমান একমত হয়ে বলেন, ‘আবারও বলছি, এটি একটি ভালো প্রস্তাব। আমরা এর কিছু কিছু কাজে রূপান্তর করছি, ভবিষ্যতে পুরোপুরি করার চেষ্টা করব। আর এ ব্যাপারগুলো ইউনিসেফের মতো সংস্থা যদি আমাদের বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়, তাহলে তো আরও ভালো।’
প্রথম আলোর এক দিনের সম্পাদক হিসেবে প্রতীকী দায়িত্ব পালন শেষে রূপকথার অভিজ্ঞতা কী? প্রশ্নের উত্তরে রূপকথা বলল, ‘আজ উপলব্ধি করেছি, রোজ আমাদের নখদর্পণে এত এত খবর পৌঁছে দিতে সাংবাদিকেরা কতটা পরিশ্রম করেন! প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখলাম। এর ফলে আমি সাংবাদিক হতে আরও বেশি অনুপ্রাণিত হয়েছি। কাজটি রোমাঞ্চকর এবং সম্মানের। এবারের বিশ্ব শিশু দিবসে আশা করি সব শিশুই যেন তাদের স্বপ্নের কাজটি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ পায়, ঠিক আমি যেমনটা পেয়েছি।’