দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বিরুদ্ধে একের পর এক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ইউজিসির সূত্রমতে, সাম্প্রতিক সময়ে তারা ১৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন রকমের অনিয়মের অভিযোগে তদন্তে নামে। এর মধ্যে ১২টিতেই বর্তমান ও সাবেক উপাচার্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। ১৮টির মধ্যে ১৩টির বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা হয়েছে এবং ৫টিতে এখনো তদন্ত চলছে। তবে এখন পর্যন্ত একজনের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
উচ্চশিক্ষার দেখভালের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) দায়িত্বশীল একজন সদস্য ও শিক্ষাবিদেরা বলছেন, উপাচার্যের মতো এত সম্মানের একটি পদে থেকে এ রকম অনিয়ম-অনাচার কেবল লজ্জারই নয়, এগুলো অপরাধ। তাই এ থেকে বের হতে হলে প্রথমত উপাচার্য নিয়োগের বিদ্যমান ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। দ্বিতীয়ত, এরপরও কোথাও কোনো নিয়মের ব্যত্যয় হলে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে। তাঁদের অভিমত, মূলত নিয়োগ ও অবকাঠামো খাতেই অনিয়মের ঘটনাগুলো বেশি হচ্ছে। সুতরাং, এই দুটি কাজে আরও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
বর্তমানে দেশে ৫২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এগুলোয় (কলেজ বাদে) প্রায় পৌনে ১২ লাখ শিক্ষার্থী ও সাড়ে ১৫ হাজার শিক্ষক রয়েছেন।
উপাচার্যদের বিরুদ্ধে অনিয়মের যত অভিযোগ
সর্বশেষ রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) উপাচার্য রফিকুল ইসলাম সেখের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে শ্যালক, দুই ভাই, স্ত্রীর ফুফাতো ভাই, চাচাতো বোন, গৃহকর্মী, তাঁর স্বামীসহ স্বজনদের কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ ওঠে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) থেকে গত ফেব্রুয়ারি মাসে জমা হওয়া এক তদন্তে বেরিয়ে আসে, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শহীদুর রহমান খান অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতি করে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে নিজের ছেলে, মেয়ে, শ্যালক-শ্যালিকার ছেলে ও ভাতিজাকে নিয়োগ দিয়েছেন। স্ত্রীকেও অধ্যাপক পদে নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন; যদিও স্ত্রীর নিয়োগপ্রক্রিয়া শেষ করার আগেই তা আটকে যায়। তদন্ত কমিটির কাছে উপাচার্য নিজের ‘অন্যায়’–এর কথা স্বীকারও করেছেন। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি; বরং সম্প্রতি ইউজিসির এক সভায় তিনি উপস্থিত হয়ে বক্তব্য দিয়ে গেছেন।
ইউজিসির সূত্রমতে, গাজীপুরের কালিয়াকৈরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটিতে ল্যাবরেটরি স্থাপনে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ইউজিসি থেকে কোর্স ও সিলেবাসের অনুমোদন দেওয়ার আগেই ল্যাবরেটরি স্থাপন করে প্রায় ছয় কোটি টাকার বিলও পরিশোধ করা হয়ে গেছে। ইউজিসির সরেজমিন প্রতিবেদনেও অনিয়মের তথ্যও উঠে এসেছে। ইতিমধ্যে ওই প্রতিবেদন জমাও দেওয়া হয়েছে। ইউজিসির তদন্ত কমিটি বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাড়া করা ভবনে সংশ্লিষ্ট প্রোগ্রাম বা বিভাগ চালু করার মতো পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ নেই। বিভাগ অনুমোদনের আগেই ৫ কোটি ৯৪ লাখ ৬৪ হাজার টাকায় তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক ‘বিগ ডেটা ল্যাব’ স্থাপন করা হয়েছে, যা প্রশ্নসাপেক্ষ। এ ল্যাবরেটরি স্থাপনে কাজ পাওয়া একটি প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষের ‘অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ’ বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
ঢাকার মোহাম্মদপুরের বছিলা এলাকায় অবস্থিত ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মুহাম্মদ আহসান উল্লাহর বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো তদন্ত করছে ইউজিসি। প্রথম তদন্ত অসম্পূর্ণ থাকায় এবার দ্বিতীয়বারের মতো তদন্ত হচ্ছে।
টাঙ্গাইলে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মো. আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে নিয়োগে অনিয়ম, সম্মানী নেওয়ায় নয়ছয় করাসহ বেশ কিছু অভিযোগে দীর্ঘদিন ধরে তদন্ত করলেও এখনো প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি ইউজিসি।
গত জানুয়ারিতে তদন্ত প্রতিবেদন হয়েছে সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে। শিক্ষা কার্যক্রম পুরোপুরি চালুর আগেই অনুমোদিত পদের বাইরে অতিরিক্ত ১০৯ জনকে নিয়োগ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অস্থায়ীভাবে দেওয়া এসব নিয়োগে উপাচার্যের আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু ক্ষমতাসীন দলের একাধিক সাংসদের স্বজনেরা রয়েছেন। কিন্তু ওই প্রতিবেদন জমা পর্যন্ত দায়িত্ব শেষ। এরপর কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা হয়নি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্যের বিরুদ্ধে ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’ স্থাপন নিয়ে অনিয়মের অভিযোগও দীর্ঘদিন ধরে তদন্ত হচ্ছে। এ ছাড়া বর্তমানে ভর্তি পরীক্ষার টাকা নিয়ে নয়ছয়ের অভিযোগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে ইউজিসি। দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুরোধে এ তদন্ত হচ্ছে।
অভিযোগ প্রমাণের পরও নেই ব্যবস্থা
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে উপাচার্যসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনিয়মের সত্যতা পেয়েছিল। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা হয়নি। বরং তিনি সংবাদ সম্মেলন করে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছিলেন, শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তাঁর বিরুদ্ধে এগুলো করা হচ্ছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এম আবদুস সোবহান শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা উদ্দেশ্যমূলকভাবে পরিবর্তন করে যোগ্যতা কমিয়ে নিজের মেয়ে ও জামাইকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। এ ছাড়া তাঁর প্রশাসন এভাবে যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্য ৩৪ জনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল। এ জন্য এসব নিয়োগ বাতিল এবং উপাচার্যের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশও করেছিল ইউজিসির তদন্ত কমিটি। কিন্তু ব্যবস্থা তো হয়ইনি, উল্টো তিনি তাঁর মেয়াদের শেষ কর্মদিবসে ১৪১ জনকে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়ে বিদায় নেন। ইউজিসি তখনো তদন্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থার সুপারিশ করেছিল। কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
ইউজিসির শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, অনিয়ম প্রমাণিত হওয়ার পরও সরকার কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণেই উপাচার্যদের অনিয়ম বন্ধ হচ্ছে না। যদি উদাহরণ সৃষ্টি করার মতো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হতো, তাহলে অন্য উপাচার্যরা ভয় পেতেন।
এর আগে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ও প্রকল্প পরিচালক হারুনর রশীদ খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তাঁর সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘প্রথম ভাইস চ্যান্সেলরের ট্রাস্ট ভবন’ নির্মাণে অনিয়ম হয়েছে। ইউজিসির তদন্তেও তা প্রমাণিত হয়। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এম অহিদুজ্জামানের বিরুদ্ধে নিয়োগে অনিয়ম করার অভিযোগের তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে ইউজিসি।
উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি নিজের ছেলেকে নীতিমালা শিথিল করে নিয়োগ দেন। পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়েও তদন্ত করেছে ইউজিসি।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগে কখনো কখনো কোনো কোনো উপাচার্যকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটলেও অপরাধের জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। একমাত্র রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আবদুল জলিল মিয়াকে দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় জেলে যেতে হয়েছিল।
মূলত, ২০০১ সালের পর থেকে উপাচার্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রবণতা বাড়তে শুরু করে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য খলিলুর রহমান, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এরশাদুল বারী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মোসলেহউদ্দিন তারেকসহ বেশ কয়েকজন উপাচার্যের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় কোনো কোনো উপাচার্য পদত্যাগ করেন এবং কাউকে কাউকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর উপাচার্যদের অনিয়ম ও দুর্নীতির ধারাবাহিকতা চলতে থাকে, যা এখনো চলছে। এর মধ্যে কয়েকজন উপাচার্যকে আন্দোলনের মুখে বিদায় নিতে হয়েছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আবদুল হাকিম সরকার, গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য খোন্দকার নাসির উদ্দিন। কিন্তু অপরাধের কোনো বিচার হয়নি।
নিয়োগেই গলদ
সাম্প্রতিক বছরগুলোর প্রবণতা হলো অধিকাংশ উপাচার্যই নিয়োগ পান দলীয় বিবেচনায়। এ কারণে তাঁরা রাজনৈতিক ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে এর অপব্যবহার করেন। ১৯৭৩ সালের আদেশে চলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের নিয়মটি হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে নির্বাচনের মাধ্যমে তিনজনের একটি প্যানেল করে সরকারের কাছে জমা দেবে। সরকার সেখান থেকে একজনকে নিয়োগ দেবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সরকার প্রথমে একজন শিক্ষককে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেয়, তারপর নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্যরা নিজেদের সুবিধামতো সিনেটে নির্বাচন করে প্যানেল দিয়ে আবারও উপাচার্য হন। কিন্তু সেটিও ঠিকমতো করা হচ্ছে না। যেমন বর্তমানে এ চার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান প্রথমে সরকার কর্তৃক নিয়োগ পেয়ে পরে সিনেটে নির্বাচনের মাধ্যমে উপাচার্য হন। কিন্তু চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা অনির্বাচিত। আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন আগে সরকার একজনকে ‘সাময়িকভাবে’ উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ দিয়েছে। অর্থাৎ তিনিও অনির্বাচিত।
অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সরাসরি সরকার উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেয়। এসব নিয়োগে প্রধান যোগ্যতাই হলো রাজনৈতিক বিবেচনা। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান মূলত ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারদলীয় শিক্ষকেরা। অনেকে তদবির করেও উপাচার্য হন। রাজনীতি ও তদবিরের মাধ্যমে যখন একজন উপাচার্য নিয়োগপ্রাপ্ত হন, তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে গিয়েও একই কাজ করেন। অথচ একসময় সরকার খুঁজে খুঁজে গুণী শিক্ষকদের উপাচার্য পদে নিয়োগ দিত। স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কয়েকজন নামকরা শিক্ষাবিদকে অনুরোধ করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন।
গত ২৯ মার্চ জাতীয় সংসদ এক সাংসদের পক্ষ থেকে বলা হয়, আগে উপাচার্যদের কথা শুনলে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসত। এখন তাঁদের দুর্নীতির খবর শুনে লজ্জায় মাথা নত হয়ে আসে। তাঁরা পরিবারের সদস্যদের নিয়োগ দিচ্ছেন, দুর্নীতি করছে। এ জন্য দলীয় বিবেচনার বাইরে গিয়ে উপাচার্য নিয়োগের দাবি করা হয়।
একই দিনে সংসদে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেছিলেন, ‘আমাদের খুবই বরেণ্য শিক্ষকেরা আছেন, যাঁদের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেলে গর্ব অনুভব করতাম। কিন্তু তাঁদের অনেকেই এই প্রশাসনিক দায়িত্ব নিতে আগ্রহী হন না। আমরা চাইলেও সবচেয়ে ভালো কেউ আগ্রহী হবেন, তেমন নয়।’
তবে সুযোগ-সুবিধা এবং স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিলে এখনো ভালো শিক্ষককে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ আছে বলে মনে করেন শিক্ষাবিদেরা। এ ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি প্রশাসনিক দক্ষতাও বিবেচনায় নিতে হবে।
সরকারের নীতি হলো প্রতিটি জেলায় কমপক্ষে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় করা। বর্তমানে ৫২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১০৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। উপাচার্য, সহ–উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। এখন সরকারি-বেসরকারি এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন শীর্ষ পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্য প্রয়োজন ৪৮০ জন ‘প্রথিতযশা শিক্ষক’। ইদানীং দেখা যায়, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও পদটি শূন্য থাকে। যেমন দীর্ঘদিন খালি থাকার পর কিছুদিন আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ।
উপাচার্য নিয়োগপ্রক্রিয়ায় বদল চান শিক্ষাবিদেরা
ইউজিসির সদস্য মুহাম্মদ আলমগীর দুই মেয়াদে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। তাঁর মতে, এ সংকট থেকে উত্তরণের জন্য প্রথমত উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে। প্রথমত, ১৯৭৩ সালের আদেশে চলা চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সব সময়ই আইন মেনে সবাইকে সিনেট নির্বাচনের মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু এখন সব সময় তা হয় না। বাকিগুলোয় যেহেতু এই নিয়ম নেই, সেখানে একটি বোর্ডের অধীন মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রথিতযশা শিক্ষককে উপাচার্য নিয়োগ যেতে পারে। যেহেতু উপাচার্যদের মেয়াদ নির্ধারিত, তাই মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই উপাচার্য নিয়োগের জন্য উপযুক্ত শিক্ষক বাছাই করতে হবে। বর্তমানে বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও গাজীপুরে অবস্থিত ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে এভাবে নিয়োগ হয়। এভাবে একজন যোগ্য ব্যক্তিকে যখন নিয়োগ দেওয়া হবে, তখন এমনিতেই অধিকাংশ অনিয়ম বন্ধ হয়ে যাবে। এরপরও যদি কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ওঠে, তখন তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক রেজিস্ট্রারের অভিমত, ইউজিসির অধীন একটি শক্তিশালী বোর্ড করে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের কাজটি করা গেলে অনেক শিক্ষক উপাচার্যই হতে চাইবেন না।
ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মনে করেন, এখন সমাজে অনিয়ম বদ্ধমূল হয়ে গেছে, সব খাতেই অনিয়ম। সমাজটাই উল্টোপাল্টা হয়ে গেছে। তাই এখান থেকে বেরোনো কঠিন। তারপরও সমাধান করতেই হবে। উপাচার্য নির্বাচন সঠিকভাবে করতে হবে। সরকার-বিশিষ্টজন সবাই মিলে বসে শিক্ষার নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত পরিবর্তনের ব্যবস্থা করতে হবে। এখানে সরকার, মানে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব অনেক বেশি। ইউজিসিকেও ভূমিকা পালন করতে হবে।