উপাচার্যদের আমলনামা-১
অপসারিত উপাচার্য হবেন সুপারনিউমারারি অধ্যাপক
দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে সরকার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবদুল হাকিম সরকারকে অব্যাহতি দিয়েছে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য থাকাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসরে যান তিনি। এখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক হওয়ার আবেদন করেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও তাঁকে সম্মানজনক ওই পদে নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। গত ৮ আগস্ট নিয়োগ প্রস্তাবটি বিভাগীয় পরিকল্পনা কমিটিতে আলোচনা হয়। তবে তাতে নোট অব ডিসেন্ট (আপত্তি) দিয়েছেন ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক আবদুস সামাদ। এরপর প্রস্তাবটি গেছে সিন্ডিকেটে। উপাচার্যের নেতৃত্বে সিন্ডিকেট একটি কমিটি গঠন করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক আবদুল হাকিম সরকার ২০১২ সালের ২৭ ডিসেম্বর পরবর্তী চার বছরের জন্য কুষ্টিয়ায় অবস্থিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিয়োগ পান। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) কয়েক দফা তদন্তে তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ মেলে। ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই এ বছরের ৩০ জুন রাষ্ট্রপতি তাঁকে অব্যাহতি দেন।
জানতে চাইলে এই ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক আবদুস সামাদ ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেওয়ার কথা স্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, দুর্নীতির অভিযোগে সরকার যাঁকে অব্যাহতি দিয়েছে, তাঁকে ছাত্রছাত্রীদের সামনে হাজির করাটা অন্যায় মনে হয়েছে। এত সব নৈতিক স্খলনের দায়ে সরকার তাঁকে অব্যাহতি দেওয়ার পর তাঁকে শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত করাটা হবে অনৈতিক ও প্রচলিত রীতিনীতির পরিপন্থী।
ইউজিসি সূত্র জানায়, আবদুল হাকিম সরকারের চার বছরের মেয়াদ চলতি বছরের ডিসেম্বরে পূর্ণ হওয়ার কথা ছিল। উপাচার্য পদে থাকা অবস্থায় তাঁর বিরুদ্ধে নিয়োগ–বাণিজ্য, উন্নয়নমূলক কাজে সম্পৃক্ত ঠিকাদারদের সঙ্গে অতি ঘনিষ্ঠতা, নিয়মবহির্ভূতভাবে মানহীন ফাজিল-কামিল মাদ্রাসাকে অধিভুক্তির অনুমোদন দিয়ে সুবিধা নেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ ওঠে। তদন্ত করে ইউজিসির তিন সদস্যের কমিটি বেশ কিছু অভিযোগের সত্যতা পেয়ে তাঁকে অপসারণের সুপারিশ করে।
গত বছর ২৩ নভেম্বর শিক্ষাসচিবের কাছে দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে নয়টি অভিযোগের প্রমাণসহ অন্যান্য অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, উপাচার্য একই সময়ে একাধিক বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন। তিনি কুষ্টিয়া থেকে প্রতি মাসে ১৪ হাজার টাকা করে বাড়িভাড়া তোলেন; আবার ঢাকার বাসার জন্যও প্রতি মাসে ৫২ হাজার টাকা করে ভাড়া তোলেন। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের চার কক্ষের একটি বাংলোতে বসবাস করতেন তিনি।
সৌদি বাদশার আমন্ত্রণে আবদুল হাকিম সরকার ২০১৪ সালে হজে যান। আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে তাঁর সব খরচ সৌদি সরকার বহন করলেও সেখান থেকে ফিরে এসে এ ভ্রমণের জন্য উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয় তহবিল থেকে ৬৫ হাজার টাকা তোলেন। এ নিয়ে বিতর্ক উঠলে পরে এই টাকা ফেরত দেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ক্ষমতা ও স্বার্থের ভাগাভাগি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য শাহিনুর রহমানের সঙ্গে তাঁর মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব ছিল। উপাচার্যের সঙ্গে সহ–উপাচার্যের যেমন বিরোধ ছিল, তেমনি ওই দুজনের সঙ্গে ছাত্রলীগের দুই অংশের সখ্য ছিল। আবার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শিক্ষকদের মধ্যে দুটি সংগঠন তৈরি হয় এবং উপাচার্য ও সহ–উপাচার্যের পক্ষে শিক্ষকেরা অবস্থান নেন।
জানতে চাইলে আবদুল হাকিম প্রথম আলোকে বলেন, প্রচলিত নিয়ম হচ্ছে সহ–উপাচার্য নিয়োগ দেওয়ার আগে উপাচার্যের সঙ্গে আলোচনা করা। কিন্তু ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি যোগ দেওয়ার কিছুদিন পর তাঁর সঙ্গে আলোচনা না করে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে সহ–উপাচার্যকে নিয়োগ দেওয়া হয়, যিনি শুরু থেকে তাঁর বিপক্ষে অবস্থান নেন।
তদন্তে বিভিন্ন অভিযোগ প্রমাণ হওয়া প্রসঙ্গে আবদুল হাকিম বলেন, তাঁর প্রতি অবিচার হয়েছে। তদন্ত নিরপেক্ষ হয়নি। কেউ কেউ নিজের স্বার্থে তদন্ত কমিটিকে ডেকে নিয়ে মনগড়া অভিযোগ উপস্থাপন করে তদন্ত করিয়েছে।