উপমহাদেশে গণতন্ত্র শুধু ভোটাভুটিতেই: অরুন্ধতী
বুকারজয়ী লেখক অরুন্ধতী রায় বলেছেন, এই উপমহাদেশে গণতন্ত্র শুধু ভোটাভুটিতেই সীমিত। সেটা জাল কিংবা সুষ্ঠু ভোট হোক না কেন। ভোট এল, রাজনীতিবিদেরা দুয়ারে এসে উন্নয়নের ফিরিস্তি দিয়ে ভোট চাওয়া শুরু করলেন। গণতান্ত্রিক চর্চা ভিন্ন হলেও এই চিত্রটা কেমন করে যেন মিলে যায়। আর যেসব প্রতিষ্ঠান গণতন্ত্রের জোরালো ভিত্তি দেয়, সেগুলোকেও নষ্ট করা হয়।
গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজধানীর মাইডাস সেন্টারে আয়োজিত ‘কথোপকথন’ অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন অরুন্ধতী রায়।
দক্ষিণ এশিয়ার বড় আলোকচিত্র উৎসব ছবিমেলার গতকাল এই কথোপকথন পর্বের নাম ছিল ‘আটমোস্ট এভরিথিং অরুন্ধতী রায় ইন কনভারসেশন উইথ শহিদুল আলম’।
প্রায় দুই ঘণ্টার অনুষ্ঠানে বিখ্যাত আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে নিজের লেখালেখি থেকে পড়ে শোনান অরূন্ধতী রায়। আলাপচারিতার শেষ দিকে তাঁর শেষ উপন্যাস দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস অবলম্বনে ভিডিওচিত্র দেখানোর সময় অরূন্ধতী রায়ের চোখ ভিজে যায় জলে। একেবারে শেষ দিকে দর্শকদের প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন আগে, এরপর প্রতিষ্ঠিত হবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র। শহিদুল আলম এই প্রসঙ্গের অবতারণা করলে অরুন্ধতী রায় বলেন, ২০ বছর আগে উন্নয়ন ছিল একমাত্র মন্ত্র। এ নিয়ে প্রশ্ন তোলা মানেই উন্নয়নের বিরোধিতা। লোকজনকে কাজ পাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হতো। আশাবাদী একদল মানুষকে নিয়ে আকাশে উড়াল দিল একটি বিমান। আকাশে গিয়ে সেটা থমকে গেল। আর আশা পরিণত হলো বিক্ষোভে। এমন এক সময়ে আমরা বাস করছি, যখন বেকারত্ব বাড়ছে। অক্সফামের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ভারতের ৫০ কোটি অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর সম্পদের সমপরিমাণ সম্পদ ৯ জন ব্যক্তির কাছে কুক্ষিগত। তাঁদের সবাই হচ্ছেন বেনিয়া। রাহুল গান্ধী জিতুক না কেন, আম্বানিরা বংশপরম্পরায় সবকিছুর মালিক। তাঁরা কয়েক পুরুষ ধরে সম্পদের মালিক। দিন দিন তাঁদের সম্পদের বিস্তার ঘটছে।
অরুন্ধতীর মতে, উন্নয়নের কথা বললে লোকজন প্রশ্ন করেন, কার জন্য এ উন্নয়ন। তাঁরা জানেন এ জন্য কাদের মূল্য দিতে হচ্ছে। গরিবের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের সহিংসতার প্রতিবাদ করতে গিয়ে তাঁদের কারাবরণ করতে হচ্ছে। অথচ ওই ৯ ধনীর সম্পদ সবার মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার কথা উঠলে পাগলামি মনে হতে পারে।
রাজনৈতিক লেখালেখিতে কেন এলেন জানতে চাইলে অরুন্ধতী রায় বলেন, দ্য গড অব স্মল থিংস প্রকাশের পরপর তিনি বিখ্যাত হয়ে উঠলেন। প্রায় নিয়মিত বিরতিতে পত্রিকার প্রচ্ছদে ছাপা হচ্ছে তাঁর ছবি। একই সময়ে ক্ষমতায় এল ডানপন্থীরা (ভারতে)। ক্ষমতায় এসেই পারমাণবিক পরীক্ষার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিল নতুন ভাষা। চারদিকে বিজয়ের উল্লাস। আকাশে-বাতাসে ছড়াতে লাগল জাতীয়তাবাদ আর ঘৃণার বিস্তার। ওই সময় তো তাঁর চুপ করে বসে থাকার সুযোগ ছিল না।
অরুন্ধতী বলেন, ‘প্রথম লেখায় পারমাণবিক পরীক্ষা আমাদের কল্পনার জগৎটা কীভাবে পাল্টে দিয়েছে, কীভাবে ভাবনার জগতে ঔপনিবেশিকতাবাদ ছড়িয়ে দিয়েছে, সেটাই বললাম। নিজেকে আমি মোবাইল রিপাবলিক হিসেবে ঘোষণা করলাম। আমার কোনো পাসপোর্ট নেই। নেই কোনো পতাকা। এভাবেই পুরোপুরি অন্য এক জগতে পা বাড়ালাম। যেই জগৎটাতে ঘুরে বেড়িয়েছে ২০টা বছর।’ এটা বলেই ছোট্ট একটা অনুচ্ছেদ পড়ে শোনান।
অরুন্ধতী বলছিলেন, ‘আমি নদীকে কেন্দ্র করে বাঁধ কিংবা কোনো উন্নয়ন প্রকল্পে বিশ্বাসী নই। নদীকে ভাগ করা যায় না। এমনকি ভারতেও বাঁধ নিয়ে, পানি নিয়ে লড়াইতে দেখা গেছে ফ্যাসিবাদের বীজ লুকিয়ে থাকে বাঁধের ভিত্তিমূলে। জাতীয়তাবাদের বীজও। আগ্রাসী মানসিকতা নিয়ে যাঁরা মনে করেন সম্পদের ন্যায্য বণ্টন হবে না, তাঁরা বুঝতে পারেন না তাঁরা কী করতে যাচ্ছেন। প্রকারান্তরে তাঁরা নিজেরাই নিজেদের গুঁড়িয়ে দেন।’
ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট, রামপালসহ নানা বিষয়ে জটিলতা প্রসঙ্গে দেশটির প্রগতিশীল গোষ্ঠী উচ্চকণ্ঠ নয় কেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে অরুন্ধতী রায় বলেন, তিনি এ মন্তব্যের সঙ্গে পুরোপুরি একমত। তিনি জেনে-বুঝে এ বিষয়গুলো নিয়ে লিখছেন। প্রয়োজনে এই ইস্যুতে তিনি বাংলাদেশে আসবেন।