উন্মুক্ত চাঁদ, নিভে যাওয়া তারার গল্প
তাঁর তুলনা হতো বিরাট কোহলির সঙ্গে। দিল্লিতেই বেড়ে ওঠা দুজনের। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জিতেছেন দুজনই। ছিলেন বিশ্বকাপজয়ী দলের অধিনায়ক। ২০০৮ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ দিয়ে পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছেন বিরাট কোহলি আর উন্মুক্ত চাঁদের আবির্ভাব ২০১২ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ দিয়ে। আজ একজন দায়িত্ব পালন করছেন ভারত জাতীয় ক্রিকেট দলের এবং অপরজন খেলার সুযোগ না পেয়ে যাচ্ছেন এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে।
মাত্র ১৬ বছর বয়সেই রঞ্জি ট্রফির দিল্লি দলে ডাক পান উন্মুক্ত চাঁদ, ১৮ বছরে সুযোগ মিলেছে আইপিএলেও। এত কম বয়সে আইপিএল বা রঞ্জি ট্রফি খেলা সহজ ব্যাপার না। কঠিন, ভীষণ কঠিন। তাঁর মতো এমন প্রতিভাবান ক্রিকেটারের সাফল্যের চূড়ায় চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু এখনো জাতীয় দলের জার্সি গায়ে দিতে পারেননি চাঁদ।
অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জিতে রাতারাতি তারকা বনে যান উন্মুক্ত ভারত চাঁদ ঠাকুর। ছয়টি ব্র্যান্ডের সঙ্গে করেন চুক্তি। মহেন্দ্র সিং ধোনি-বিরাট কোহলিদের সঙ্গে একটি কোমল পানীয়ের বিজ্ঞাপনেও দেখা যায় তাঁকে। কিন্তু সেই তারকাখ্যাতিই কাল হলো, বাজে ফর্ম আর মাঠের বাইরের কিছু কারণে অনেকটাই হারিয়ে গেলেন।
ভারতের হয়ে ২০১৪, ২০১৬, এমনকি ২০১৮ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলা অনেকেই ইতিমধ্যেই জাতীয় দলে খেলে ফেলেছেন। কয়েকজন নিয়মিত খেলছেন ভারতের ‘এ’ দলের হয়ে। ২০১৮ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের অধিনায়ক পৃথ্বী শ খেলছেন জাতীয় দলের হয়ে, সহ-অধিনায়ক শুভমান গিলও আছেন স্কোয়াডে।
২০১৬ সালের ঋষভ পন্তও জাতীয় দলের পরিচিত মুখ। অনেকেই আছেন জাতীয় দলের আশপাশে। ২০১২ সালে চাঁদেরই নেতৃত্বে খেলা হানুমা বিহারি ও সন্দীপ শর্মাও ইতিমধ্যে খেলে ফেলেছেন জাতীয় দলে। কিন্তু চাঁদ ‘এ’ দল পর্যন্তই যেতে পেরেছেন সর্বোচ্চ।
উন্মুক্ত চাঁদকে বলা হতো বড় ম্যাচের খেলোয়াড়। বলা হবেই না-বা কেন? ২০১২ সালে ভারত, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ও স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে অনুষ্ঠিত টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৯৪ ও ফাইনালে স্বাগতিক অজিদের বিরুদ্ধে খেলেছিলেন অপরাজিত ১১২ রানের ঝলমলে এক ইনিংস। সেই সিরিজে ৫ ম্যাচেই চাঁদ করেছিলেন ২৮১ রান। একই বছর জুনে অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপের সেমিফাইনালে ১১৬ ও ফাইনালে ১২১ রান করেছেন। মাত্র ৩ ম্যাচে সেই টুর্নামেন্টে ২৮৬ রান করেন। ২০১২ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ফাইনালেও সেঞ্চুরি (১১১*) হাঁকান চাঁদ।
ভারত অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে ২১ ম্যাচে প্রায় ৬৮ গড়ে করেছিলেন ১১৪৯ রান। হাঁকিয়েছেন পাঁচটি করে শতক ও অর্ধশতক। নজরকাড়া এসব পারফরম্যান্সের সুবাদে মাত্র ১৮ বছর ১৫ দিন বয়সে ২০১১ সালের আইপিএলে দিল্লি ডেয়ারডেভিলসের হয়ে অভিষেক হয় উন্মুক্ত চাঁদের। ২০১৩ সাল পর্যন্ত ডেয়ারডেভিলসেই খেলেন তিনি। কিন্তু পুরোপুরিই ব্যর্থ চাঁদ ৭ ম্যাচে করেছিলেন মাত্র ৬১ রান। ৬৫ লাখ রুপির বিনিময়ে তাঁকে নেয় রাজস্থান রয়্যালস। এরপরে গেছেন মুম্বাই ইন্ডিয়ানসে।
খেলার সুযোগ পেতেই মুম্বাইকে ছেড়ে অন্য ফ্রাঞ্চাইজিতে যেতে চেয়েছিলেন চাঁদ। কিন্তু তখনই তাঁর জীবনের সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। ২০১৮ সালের আইপিএলের নিলামের চার দিন আগে ঘোষণা করা হয় দিল্লির রঞ্জি ট্রফি স্কোয়াড, বাদ পড়েন চাঁদ। আইপিএলেও সুযোগ পাননি। এর আগেও একই ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলেন ২০১৬ সালে, সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফির জন্য দিল্লি টি-টোয়েন্টি দল থেকে বাদ পড়েছিলেন। অথচ সেই টুর্নামেন্টের আগের সিরিজে ভারত ‘এ’ দলের হয়ে সর্বোচ্চ স্কোরার ছিলেন চাঁদ।
দিল্লি দল থেকে বাদ পড়ার হতাশা নিয়ে তাই ২০১৮ সালে পাড়ি জমান নিজ জন্মভূমি উত্তরাখন্ডে। বর্তমানে উত্তরাখন্ড দলের অধিনায়কত্বও করছেন। লিস্ট-এ ক্রিকেটে ৪১.৩৩ গড়ে করেছেন ৪৫০৫ রান। ফার্স্ট ক্লাসে ৩৩৭৯ রান করেছেন ১১৩ ইনিংসে। টি-টোয়েন্টিতে আছে ৩টি সেঞ্চুরি।
তবে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী খেলতে না পারায় কেউ কেউ আবার প্রশ্ন তুলছেন তাঁর ব্যাটিং-সামর্থ্য আর টেকনিক নিয়ে। তিনি হতে পারতেন বিশ্ব ক্রিকেটের এক তারকা, হয়তো বিরাট কোহলিদের সঙ্গে তাঁর খ্যাতিও ছড়িয়ে পড়ত সবখানে। কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক সেটা পারেননি। তবে এখনো ফুরিয়ে যাননি চাঁদ। বয়স ২৭। বর্তমানে নিয়মিতই খেলছেন ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটে।
তিনি এসেছিলেন তারা হয়ে, উদীয়মান তারকা হয়ে। কিন্তু সেই তারা জ্বলে উঠতে পারেনি পুরোপুরি। কিছুটা জ্বলে এখন প্রায় নিভেই গেছে। আবারও হয়তো জ্বলে উঠতেও পারেন। ক্রিকেট অনিশ্চয়তার খেলা বলেই হয়তো এখনো সে আশা করেন চাঁদ।