উচ্চতর স্কেল নিয়ে বিভ্রান্তিতে শিক্ষক সমাজ
সম্প্রতি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর থেকে একটি চিঠিতে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের উচ্চতর স্কেল প্রদানের জন্য অনলাইনে আবেদন করতে বলা হয়। চিঠিটি শিক্ষকদের নজরে আসার পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রীতিমতো হইচই পড়ে যায়। বিশেষ করে ৯ম গ্রেডের শিক্ষকদের মধ্যে বিভ্রান্তি লক্ষ করা যায় একটু বেশি। বিভ্রান্তিতে পড়ার একটি বড় কারণও রয়েছে বটে। আগের নীতিমালা অনুযায়ী অনুপাত প্রথার মারপ্যাঁচে পড়ে যাঁরা সহকারী অধ্যাপক হতে পারতেন না, তাঁরা ৮ বছর পর সিলেকশন গ্রেড পেয়ে নবম গ্রেড থেকে সপ্তমে যেতেন। কিন্তু বর্তমান নীতিমালা অনুযায়ী তাঁরা ১০ বছর পরে ৯ম গ্রেড থেকে ৮ম গ্রেড এ যাবেন।
তা ছাড়া সদ্য সরকারি স্কুল–কলেজগুলোর শিক্ষকদের আত্তীকরণ সম্পন্ন না হওয়ায় তাঁরা এখনো এমপিওভুক্ত রয়ে গেছেন। তাঁদের অনেকেরই ১০ বছর অতিক্রান্ত হলেও আদৌ আবেদন করতে পারবেন কি না, সে রকম কোনো দিকনির্দেশনা চিঠিতে উল্লেখ নেই। আমার কাছেও অনেকে ফোন করে জানতে চেয়েছে। যে ১৩ রকমের কাগজপত্র চাওয়া হয়েছে তার মধ্যে জিবি রেজল্যুশনের কথাও উল্লেখ রয়েছে, যা সরকারি স্কুল–কলেজগুলোতে বিলুপ্ত হয়েছে জিও জারির পরে থেকেই। সরকারীকরণের যে ধীরগতি, তাতে শিক্ষকদের আবেদনের সুযোগে করে দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
‘এমপিও নীতিমালা ২০১০’–এর একটি সংশোধিত পরিপত্র প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালের ২৪ মার্চ। এ পরিপত্রের ১১.৪ ধারায় বলা হয়, ‘এমপিওভুক্ত প্রভাষকেরা প্রভাষক পদে এমপিওভুক্তির ৮ বছর পূর্তিতে ৫:২ অনুপাতে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাবেন। তাতে মোট পদসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে না। তবে শর্ত থাকে যে নিয়োগকালীন তৎকালীন নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন প্রভাষকেরা এর সুবিধা পাবেন। অন্যান্য প্রভাষকেরা শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার ৮ বছর পূর্তিতে একটি সিলেকশন গ্রেড প্রাপ্ত হবেন (৯ম থেকে ৭ম)।’
একই পরিপত্রের ১১.৫ ধারায় বলা হয়, ‘সহকারী অধ্যাপকদের মধ্যে থেকে ৩:১ অনুপাত অনুযায়ী সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাবেন। তবে তাতে মোট পদসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে না।’
এখানে ৯ম গ্রেডের শিক্ষকদের মধ্যে যাঁরা সহকারী অধ্যাপক হতে পারবেন না, তাঁদের ৮ বছর পরে ৯ম গ্রেড থেকে ৭ম গ্রেডে বেতন-ভাতা নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে। অপর দিকে ১১.৫ ধারায় সহযোগী অধ্যাপক পদের যে কথা বলা হয়েছিল, তা আলোর মুখ দেখেনি দীর্ঘ ১০ বছরেও। উপরন্তু ০৮ বছর পরে ‘এমপিও নীতিমালা ২০১৮’ নামে নতুন যে নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে, সেখান থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের সহযোগী অধ্যাপকের পদ!
‘এমপিও নীতিমালা ২০১৮’ প্রকাশিত হয় ওই বছরের ১২ জুন। এ নীতিমালার ১১.৪ ধারায় বলা হয়, ‘এমপিওভুক্ত প্রভাষকেরা প্রভাষক পদে এমপিওভুক্তির ৮ (আট) বছর পূর্তিতে ৫:২ অনুপাতে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাবেন। এতে মোট পদসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে না। অন্য প্রভাষকগণ এমপিওভুক্তির ১০ বছর পূর্তিতে বেতন গ্রেড ৯ম থেকে ৮ম প্রাপ্ত হবেন। ১০ বছর পূর্তিতে উচ্চতর গ্রেড এ বেতন প্রাপ্তির পর পরবর্তী ৬ বছরে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত না হলে ৬ বছর পূর্তিতে বেতন গ্রেড ৮ম থেকে ৭ম প্রাপ্য হবেন। সমগ্র চাকরিজীবনে দুটির বেশি উচ্চতর গ্রেড/টাইম স্কেল প্রাপ্য হবেন না।’
পূর্বের নীতিমালা অনুযায়ী ৯ম গ্রেডের একজন শিক্ষক ৮ বছর পর ২২ হাজার টাকা স্কেল থেকে ৭ম গ্রেডে অর্থাৎ ২৯ হাজার টাকা স্কেলে যাওয়ার কথা থাকলেও বর্তমান নীতিমালা অনুযায়ী তাঁরা যাবেন ১০ বছর পর ৮ম গ্রেডে অর্থাৎ ২৩ হাজার টাকা স্কেলে। আরও স্পষ্ট করে বললে আগের নীতিমালা অনুযায়ী ৮ বছর পর বেতন স্কেল ৭ হাজার টাকা বৃদ্ধি পাওয়ার কথা থাকলেও বর্তমান নীতিমালা অনুযায়ী তা ১০ বছরে বাড়বে মাত্র ১ হাজার টাকা। বেতন স্কেলের ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট যোগ হয়ে আমাদের শিক্ষকদের এ টাকা ইতিপূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে।
বাংলাদেশ এখন অনেক এগিয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থায় করোনার কারণে সাময়িকভাবে একটু সমস্যা থাকলেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আমরা এগিয়ে যাব ইনশা আল্লাহ। আমাদের দেশের মানুষ এক সময়ে এক বেলা ভাত আর দুই বেলা রুটি বা অন্য কিছু খেয়ে দিনাতিপাত করত। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশের মানুষ তিনবেলাই ভাত খাওয়ার সক্ষমতা রাখে। জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হয়েছে ব্যাপকভাবে। নীতিনির্ধারকগণ যারা আমাদের জন্য নীতিমালা তৈরিসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ কাজে অবদান রাখেন, তাঁদেরও সুযোগ-সুবিধা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। একসময় যাঁরা গাড়ি সুবিধা পেতেন না, এখন তাঁরা গাড়ি সুবিধা পাচ্ছেন। সঙ্গে ড্রাইভার এবং তেল খরচও। ইন্টারনেট, টেলিফোন বিলসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা তো আছেই।
কিন্তু আমাদের শিক্ষক সমাজের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত না হয়ে বরং তা আরও হ্রাস পায়! কারণ কী? শিক্ষকদের ক্ষেত্রে এত কৃপণতা কেন? অনুপাত প্রথার কারণে একজন শিক্ষক সহকারী অধ্যাপক হয়ে ৯ম গ্রেড থেকে যেখানে ৬ষ্ঠ গ্রেডে যান, সেখানে তাঁরই সহকর্মীরা প্রায় একই সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েও তাঁর থেকে ২ বছর পরে ৮ম গ্রেডে যাবেন, এটা কেমন কথা! তা ছাড়া পূর্বের নীতিমালা অনুযায়ী নতুন নীতিমালায় সহযোগী অধ্যাপকের পদ রাখা হয়নি কেন? এসব প্রশ্ন শিক্ষক সমাজের মাথায় প্রতিনিয়ত ঘুরপাক খাচ্ছে। নতুন জাতীয় পে-স্কেল ২০১৫ সালে কার্যকরের পর সিলেকশন গ্রেড বন্ধ হওয়ার দীর্ঘ পাঁচ বছরেও উচ্চতর গ্রেড যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি না করায় অনেক শিক্ষকের চাকরিকাল ১২–১৩ বছর পেরিয়ে গেছে। এগুলো আমাদের শিক্ষক সমাজের সঙ্গে প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়। এত কিছুর পরও সম্প্রতি যারা এই করোনার প্রাদুর্ভাবের সময়ে এই মহৎ উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন, সংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি।
বর্তমান সরকার শিক্ষাবান্ধব সরকার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদার ব্যাপারে খুবই আন্তরিক। এবারের বাজেটে শিক্ষা খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে প্রণয়ন করায় শিক্ষাবান্ধব সফল রাষ্ট্রনায়ক প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। শিক্ষার তিনটি বিভাগ ও মন্ত্রণালয় মিলে বাজেটে সর্বমোট প্রস্তাব করা হয় ৬৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ৭ হাজার ১৭ কোটি টাকার বেশি। একটি শিক্ষিত জাতিই পারে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে, প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করেন বলেই বাজেটে এর প্রতিফলন ঘটেছে।
ইতিপূর্বে নন–এমপিও শিক্ষক সমাজকে প্রণোদনার আওতায় আনায় প্রধানমন্ত্রীকে আবারও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আশা করছি, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সদ্য সরকারি স্কুল–কলেজসহ এমপিওভুক্ত এবং নন-এমপিও প্রতিষ্ঠানের সব পর্যায়ের নন–এমপিও (খণ্ডকালীনসহ) শিক্ষকদের এ প্রণোদনার আওতায় নিতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। পাশাপাশি বিধি মোতাবেক নিয়োগপ্রাপ্ত নন–এমপিও শিক্ষকদের (অনার্স-মাস্টার্সসহ) এমপিওভুক্তির জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করার জোর দাবি জানাচ্ছি।
আরেকটি ব্যাপার না বললেই নয়, উচ্চতর স্কেলের জন্য আবার নতুন করে আবেদন করার কী দরকার? যাবতীয় কাগজপত্র যাচাই-বাছাই শেষেই তো তাঁরা এমপিওভুক্ত হয়েছেন। বিশ্বায়নের এ যুগে ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেখানে কাজকে দ্রুততর করতে নির্দেশ দিচ্ছেন, সেখানে নতুন করে আবেদন এবং তেরো রকমের কাগজপত্র চাওয়া নিতান্তই অপ্রয়োজন। ১০ বছর পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে উচ্চতর স্কেলে বেতন-ভাতা নির্ধারণ খুব একটা কঠিন কাজ বলে মনে হয় না। এতে শিক্ষক-কর্মচারী এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণের ভোগান্তিও কমে যাবে আশা রাখি।
সদ্য সরকারি স্কুল-কলেজসহ সব শিক্ষকের উচ্চতর স্কেলের ব্যাপারে বিভ্রান্তির অবসান ঘটিয়ে এবং শিক্ষকদের পূর্বের বিধিমালায় উল্লিখিত সহযোগী অধ্যাপকের পদ ঠিক রেখে সুযোগ–সুবিধা বহাল রাখার জন্য কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করছি। পরিশেষে করোনার এই মহামারি থেকে রক্ষা পেতে সরকারি নির্দেশনা মেনে আমরা সবাই ঘরে থাকি, দেশটাকে ভালো রাখি।
*লেখক: যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সরকারি কলেজ স্বাধীনতা শিক্ষক সমিতি, কেন্দ্রীয় কমিটি। [email protected]