স্বচ্ছতার জন্যই ইসি গঠনের ১০ নাম প্রকাশ করা উচিত

গতকাল রোববার সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাউঞ্জে অনুসন্ধান কমিটির বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন কমিটির সভাপতি বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। নির্বাচন কমিশন গঠনে ১০ জনের নাম চূড়ান্ত করে রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেবে এই কমিটি
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এবং চার নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য অনুসন্ধান কমিটি যাঁদের নাম প্রস্তাব করবে, স্বচ্ছতার স্বার্থে তা প্রকাশ করা উচিত বলে মনে করেন বিশিষ্টজনেরা। তাঁরা বলছেন, রাষ্ট্রপতির কাছে প্রস্তাব পাঠানোর আগে নামগুলো প্রকাশ না করা আইনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। এতে মানুষের মনে সন্দেহ তৈরি হবে।

দেশে এবারই প্রথম আইনের আলোকে নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন করা হচ্ছে। আইনে কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার যোগ্যতা ও অযোগ্যতা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সিইসি ও অন্য নির্বাচন কমিশনারদের শূন্য পদে নিয়োগের জন্য যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করবেন রাষ্ট্রপতি। কমিটি প্রতিটি শূন্য পদের বিপরীতে দুজন ব্যক্তির নাম সুপারিশ করবে। সেখান থেকে রাষ্ট্রপতি চূড়ান্ত নিয়োগ দেবেন।

এখন সিইসি ও চারটি নির্বাচন কমিশনারের পদ মিলিয়ে মোট পাঁচটি পদ শূন্য আছে। বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন অনুসন্ধান কমিটি ১০টি নাম চূড়ান্ত করার কাজ করছে। সম্প্রতি বিভিন্ন দল, ব্যক্তি ও সংগঠনের কাছ থেকে পাওয়া ৩২২টি নাম প্রকাশ করেছে অনুসন্ধান কমিটি। কিন্তু তারা যে ১০ জনের নাম চূড়ান্ত করে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করবে, তা প্রকাশ করা হবে না বলে ইতিমধ্যে জানানো হয়েছে।
ইসি গঠনে আইনটি প্রণয়নের আগে থেকেই বিভিন্ন মহলের দাবি ছিল, নিয়োগের আগে যেন অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশ করা নামগুলো প্রকাশ করার বিধান আইনে রাখা হয়। গত জানুয়ারিতে আইনটি যেদিন জাতীয় সংসদে পাস হয়, সেদিনও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ও বিএনপির পক্ষ থেকে সংশোধনী প্রস্তাব দিয়ে এই বিধান যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু এই সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়নি।

এখন ইসি গঠনে করা আইনে অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশ করা নামের তালিকা প্রকাশের বাধ্যবাধকতা নেই। আবার প্রকাশ করা যাবে না—এমনটিও সরাসরি বলা নেই। আইনে বলা আছে, অনুসন্ধান কমিটি ‘স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নীতি’ অনুসরণ করে দায়িত্ব পালন করবে।

এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, নাম প্রকাশ না করার অনুসন্ধান কমিটির যে সিদ্ধান্ত, তা আইনের ৪ (১) ধারার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। এই ধারায় অনুসন্ধান কমিটিকে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করে কাজ করতে বলা হয়েছে।

বদিউল আলম মজুমদার বলেন, অনুসন্ধান কমিটি যদি নামগুলো প্রকাশ না করে, তাহলে স্বচ্ছতা থাকবে না। কারণ, স্বচ্ছতা অর্থ হলো কোনো কিছু লুকানো নয়। এই ধারাতে আরও বলা হয়েছে, আইনে বর্ণিত যোগ্যতা, অযোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, সততা ও সুনাম বিবেচনা করে অনুসন্ধান কমিটি নাম সুপারিশ করবে।

সুনামের মানদণ্ড কী—এমন প্রশ্ন রেখে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে জনগণের ধারণা কী, তা গুরুত্বপূর্ণ। নামগুলো প্রকাশ করা হলে মানুষ তাঁদের মতামত দিতে পারবেন। কোনো ব্যক্তিকে নিয়ে বিতর্ক থাকলে, তা নিয়ে নিয়োগের আগেই বিতর্ক হওয়া উচিত।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন পাসের সময় ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন প্রস্তাব দিয়েছিলেন, অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশ করা নামগুলো জনগণের সামনে প্রকাশ করা এবং এ বিষয়ে মতামত দেওয়ার সুযোগ রাখার বিধান সংযোজনের।

অনেকটা একই প্রস্তাব ছিল বিএনপির সাংসদ রুমিন ফারহানার। তিনি সংশোধনী প্রস্তাবে বলেছিলেন, অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশ করা নামগুলো এবং যোগ্যতা ও সম্পত্তির হিসাব হলফনামা আকারে প্রকাশ এবং নামগুলো নিয়ে গণশুনানির ব্যবস্থা রাখার বিধান যুক্ত করা হোক। ইসি হিসেবে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা ব্যক্তিদের জীবনবৃত্তান্ত প্রকাশ করার বিধান যুক্ত করার প্রস্তাব দেন বিএনপির আরেক সাংসদ হারুনুর রশীদ। এসব প্রস্তাবের কোনোটাই গ্রহণ করা হয়নি।

অনুসন্ধান কমিটির সঙ্গে বৈঠকে বিশিষ্ট নাগরিকদের অনেকে দাবি জানিয়েছিলেন, যেন প্রস্তাবিত নামগুলো প্রকাশ করা হয়। সুজন সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিল, রাষ্ট্রপতির কাছে নাম প্রস্তাব করার তিন দিন আগে যেন নামগুলো প্রকাশ করা হয়। তবে অনুসন্ধান কমিটি এই দাবিও আমলে নেয়নি।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, রাষ্ট্রপতির কাছে অনুসন্ধান কমিটি কাদের নাম প্রস্তাব করছে, তা প্রকাশ করা হলে প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ হতো। আইনে নামের তালিকা প্রকাশ করার কথা নেই, আবার প্রকাশ করা যাবে না, এটিও বলা নেই। বিষয়টি উহ্য রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুসন্ধান কমিটির। তারা বলছে, নাম প্রকাশ করা হবে না। সে ক্ষেত্রে মানুষের মনে একটি সন্দেহ থেকেই যাবে।